ঢাকা: আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জানানো হয়েছে।
শনিবার (১০ মে) রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতা জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য আন্দোলন করে আসছিল। এ পর্যায়ে গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। এ অবস্থায় ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ না করে সরকারকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকও করেছিলেন। কিন্তু এতদিনেও তা চূড়ান্ত না হওয়ায় ছাত্ররা আবারও আন্দোলনে নামেন। এই আন্দোলনের মুখে শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভা শেষে জানানো হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থকগোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে জানিয়ে বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আজকের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। ’
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ওই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলাসহ সহিংসতায় এক হাজার চারশ’ জন নিহত হন। আহত হন হাজার হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে কেউ পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, কেউ হারিয়েছেন চোখের আলো।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তাদের বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছাত্র-জনতা। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে হত্যা মামলার আসামি আওয়ামী লীগের লোকজন গোপনে দেশ ছেড়ে পালালে ক্ষোভ ঝাড়তে থাকে ছাত্র-জনতা। এর মধ্যে আবারও ঢাকা, গোপালগঞ্জসহ দেশের কিছু স্থানে অভ্যুত্থানকারীদের ওপর আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডারদের হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে।
অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার অভিযোগ, প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষকে আহত করার পরও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বা মন্ত্রী-এমপিদের কারও বক্তব্য-বিবৃতিতে কোনো ধরনের অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ দেখা যাচ্ছিল না। উপরন্তু অভ্যুত্থান নিয়ে তারা নানা ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব দেখিয়ে আন্দোলনকারীদেরই ভবিষ্যতে দেখে নেওয়ার হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল। বিশেষ করে সাইবার স্পেসে অভ্যুত্থানকারী ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সমন্বিত অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল তারা। এ নিয়ে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছিল। এর মধ্যে ৭ মে গভীর রাতে চুপিসারে আওয়ামী লীগ আমলের দুইবারের রাষ্ট্রপতি ও হত্যা মামলার আসামি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের প্রেক্ষাপটে দলটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি আরও জোরদার হয়।
৮ মে রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। এতে হাসনাতের দল এনসিপির পাশাপাশি যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, আপ বাংলাদেশ, জুলাই ঐক্য, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী, ইনকিলাব মঞ্চসহ গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন।
শুক্রবার (৯ মে) সকালে ওই কর্মসূচি থেকে জুমার নামাজের পর বড় সমাবেশের ঘোষণা দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। এজন্য যমুনা ভবনের পাশেই মিন্টো রোডসংলগ্ন ফোয়ারার কাছে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিকেলে সেখানে সমাবেশ শেষে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ অবরোধ করেন। ওই কর্মসূচিতে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যোগ দেয়। হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কর্মসূচি থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। শনিবার রাতে ওই আলটিমেটাম শেষ হলে আন্দোলনকারীরা আবার শাহবাগ ছেড়ে যমুনার অদূরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। এর মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠক থেকেই দলের বিচারে সংশোধনী, বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত এলো।
ইএস/এএটি