‘আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। ছেলেকে এখন আর ফিরে পাবো না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথা বলেছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ইলিম হোসেনের (৪২) মা আনোয়ারা বেগম (৬০)। ইলিম গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার রাখালিয়াচালা এলাকার বেলায়েত হোসেনের ছেলে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে সারাদেশে যখন নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চলছিল, ঠিক সেই সময় গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর আনসার একাডেমি এলাকায় মিছিলে যোগ দেন ইলিম হোসেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে সেই মিছিলে চালানো হয় গুলি। এতেই শহীদ হন ইলিম।
দীর্ঘ ১১ মাসেও ছেলের মৃত্যুর শোক কাটেনি আনোয়ারার। ছেলের কথা জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। রাখালিয়াচালার বাড়ি থেকে ঘুরে ঘুরেই যান ছেলের কবরের পাশে। কাঁদেন আর ছেলের স্মৃতিচারণ করে বিভিন্ন কথা বলতে থাকেন। ছেলেহারা মায়ের এ আর্তনাদ শেষ হবে না কখনোই।
স্মৃতিচারণ করে আনোয়ারা বেগম জানান, মেয়ের হাতের খাবার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ইলিম হোসেন। এটাই ছিল তার বাড়ির শেষ খাবার। তিনি বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু গুলিবিদ্ধ লাশ হয়ে।
ইলিম হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিজ ঘরের বারান্দায় মা আনোয়ারা ও বাবা বেলায়েত হোসেন বসে আছেন। ছেলের কথা জানতে চাইতেই মা হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন, করতে থাকেন বিলাপ।
পরে প্রতিবেদককে নিয়ে যান ছেলের কবরের পাশে। সেখানে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, “ছেলেটা সেদিন বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বলে যায়, ‘মা, টিভিতে দেখলাম সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন, আমি দোকানে গিয়ে ভাষণ শুনে ফিরে আসবো। ’ সেখানে গিয়ে ইলিম হোসেন যোগ দেয় ছাত্র-জনতার সঙ্গে। এসময় তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। সেই গুলি লাগে ইলিম হোসেনের বুকে। ”
পারটেক্স বোর্ডের ব্যবসা করতেন ইলিম। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর আনসার একাডেমির সামনে ছিল তার পারটেক্স বোর্ডের দোকান। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ইলিমের পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তার বড় মেয়ে এরিন সিকদার (১৬) এবার এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৫৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। ছোট মেয়ে ইর্জা সিকদার (৩) ও ছেলে ইরাত সিকদার (৯)। বর্তমানে বাড়ি ভাড়ার কিছু টাকা দিয়েই তাদের সংসার চলছে। ২৭ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন ইলিম। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক টাকা পরিশোধ হয়েছে।
ইলিম হোসেনের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তাকে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। সরকার থেকে বলা হয়েছে, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেবে, সেখানে দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা। এছাড়া জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেওয়া হয় দুই লাখ টাকা। এছাড়া আর কোনো টাকা-পয়সা পাইনি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা, বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা প্রায়ই বাড়িতে এসে আমাদের খোঁজখবর নিয়ে যান। কেমন আছি বা কোনো সমস্যা আছে কি না তা জানতে চান। ’
কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তা, ইলিমের সন্তানরা যেন ভবিষ্যতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায় এবং পরবর্তী সরকারও যেন তাদের দায়িত্ব নেয়—এমন দাবি করে জুলাই শহীদ ইলিম হোসেনের পরিবার।
আরএস/এইচএ