ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

বাইরে ফিটফাট আসলে ‘মহাদুর্নীতিবাজ’-দ্বিতীয় পর্ব

যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের রত্নভান্ডার

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:১২, জুলাই ২২, ২০২৫
যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের রত্নভান্ডার সাইফুজ্জামান

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাইফুজ্জামান বুদ্ধিমান দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সব টাকাই তিনি বিদেশে পাঠিয়েছেন।

সেখানে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তবে সাইফুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য যুক্তরাজ্য। এখানেই তিনি পাচার করেছেন ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতের অন্যতম বিনিয়োগকারী হলেন এই দুর্নীতিবাজ। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে তাঁর বেশ কিছু সম্পদ জব্দ হয়েছে, চলছে তদন্ত।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ) শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ির মালিক। এর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় নির্মাণপ্রতিষ্ঠান থেকে কেনা। বাড়িগুলোর বাজারমূল্য ৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি।

গত বছর কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম আলজাজিরার ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রথম উঠে আসে এ তথ্য।

লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পদ দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সাইফুজ্জামান সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও সাইফুজ্জামানের সম্পদের বর্ণনা উঠে এসেছে। কীভাবে তিনি বিদেশে এত সম্পদ গড়েছেন, সেই ধারণাও পাওয়া গেছে।

সাইফুজ্জামান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই কাছের ও বিশ্বস্ত। তিনি ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ভূমিমন্ত্রী করেন। সাইফুজ্জামানও আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সত্যি বলতে আমিও। ’

আলজাজিরার অনুসন্ধানী দলের কাছে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান তাঁর বিলাসী জীবনের গল্পও করেছেন। সেখানে নিজের জুতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা টেইলর-মেডের জুতা। আমি হেরডসেও কাস্টম মেড (নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি) জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটি তৈরি হতে চার মাস লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটি ৩ হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে। ’

এ বিশেষ জুতা তৈরির বিষয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, ‘এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাগুলোর দাম ৬ হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম ৩ হাজার পাউন্ড। এটা খুবই ভালো। ’

স্যুট পছন্দ করেন জানিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, প্রতিবার তিনি লন্ডনে গেলে ‘সুপার ২০০’ স্যুট কেনেন। এ ধরনের স্যুটের দাম ৬ থেকে ৮ হাজার পাউন্ড। কেনালি বন্ড স্ট্রিটে গিয়ে কেনেন তিনি। এরপর তারাই বাসায় পৌঁছে দেয়।

আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে অনুসরণ করছিল তাদের অনুসন্ধানী দল। তাঁর বেতন (বার্ষিক) ছিল ১৩ হাজার ডলার। অথচ তিনি যুক্তরাজ্যে বিপুল সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।

লন্ডনে বাড়িগুলো কেনা হয় ডেভেলপারের মাধ্যমে। সাইফুজ্জামান ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কেনেন। তাঁর বাড়িগুলোর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনা।

সাইফুজ্জামানের কেনাকাটা সেখানেই থেমে থাকেনি। ২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও সম্পদ কেনেন তিনি। তাঁর বেশির ভাগ সম্পদই ভাড়া দিয়ে থাকেন। ২০২০ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ৪০ কোটি ডলার।

রিপন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের গ্রাহকের (সাইফুজ্জামানের) লন্ডনে ৩০০টির বেশি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য ২০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেন তিনি। ’

এই রিপন মাহমুদ সম্পর্কে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বক্তব্য হলো-লন্ডন ও যুক্তরাজ্যের সব সম্পত্তি রিপনের মাধ্যমেই তিনি কিনেছেন। রিপন তাঁর প্রধান লোক। তিনি তাঁর ভাই।

২০২২ সালে লন্ডনের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় একটি প্রপার্টি ১১ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি হয়। রিজেন্ট পার্ক থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এ প্রপার্টির অবস্থান। বিখ্যাত লর্ডস ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অবস্থানও এর ঠিক পাশেই। লন্ডনের সবচেয়ে দামি এলাকাগুলোর মধ্যে এটি একটি। এ প্রপার্টিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু সাদা রঙের বাড়ি। বাড়িগুলোয় যে জানালা আছে, এর বিস্তার মেঝে থেকে একেবারে ছাদ পর্যন্ত। সর্পিলাকৃতির সিঁড়িগুলো উঠে যায় ওপরের কয়েক তলা পর্যন্ত। সেই সঙ্গে আছে সিনেমা হল ও জিমনেসিয়ামও।

এ প্রপার্টির মালিক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৭৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রায়) ৩৫০টির বেশি সম্পত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য।

মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ নিউজের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউসের করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে এ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে।

সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন, যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন।

নিউইয়র্কে সদর দপ্তর থাকা আন্তর্জাতিক এ সংবাদ সংস্থা যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় আড়াই শ প্রপার্টির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, যখন এ প্রপার্টিগুলো কেনা হয়, তখন যুক্তরাজ্যজুড়ে তীব্র আবাসনসংকট চলছিল এবং এর ৯০ ভাগই ছিল সদ্য তৈরি নতুন বাড়ি।

এ লেনদেনগুলো এমন এক সময়ে করা হয়েছিল, যখন রুশ ধনকুবেররা খুব সহজেই তাঁদের সম্পদ যুক্তরাজ্যে লুকিয়ে রাখতে পারছেন-এমন সমালোচনার মুখে ব্রিটিশ সরকার সম্পত্তির বিদেশি মালিকানায় আরও স্বচ্ছতা দেখাতে চাইছিল। ইউক্রেনে মস্কোর আগ্রাসনের পর যা আরও জরুরি হয়ে ওঠে।

ব্লুমবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে সাইফুজ্জামানের অন্তত পাঁচটি প্রপার্টি খুঁজে পেয়েছে। মিউনিসিপ্যাল প্রপার্টির নথি অনুসারে, এসব সম্পত্তি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রাকনির্বাচনি ঘোষণায় সাইফুজ্জামান তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন টাকা (২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার) এবং তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯ লাখ ৯৩ হাজার ডলার বলে জানান। তিনি বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণাপত্রে তাঁর যুক্তরাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দেখাননি।

আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে দুবাই যান সাইফুজ্জামান চৌধুরী। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের মালিকানাধীন সম্পত্তি জব্দ করেছে দেশটির জাতীয় অপরাধ সংস্থা (এনসিএ)। সাইফুজ্জামান চৌধুরী এসব সম্পদ বিক্রি করতে পারবেন না। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের নামে এ পর্যন্ত চার দেশে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। পাচার করা টাকায় তিনি বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি এবং যুক্তরাজ্যে ৩৩৬টি বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ১টি, সিঙ্গাপুরে ৩টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪টি ব্যাংক হিসাব শনাক্ত করা হয়েছে।

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।