কক্সবাজার থেকে ফিরে: জীবিকার তাগিদে কক্সবাজারের শিশুরা ছুটে যায় সমুদ্র সৈকতে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের কাছে সিদ্ধ ডিম, পানি, ফুল, ফুলের মালা বিক্রি ও পর্যটকদের হাত-পা, শরীর-মাথা ম্যাসাজ করেও টাকা-পয়সা রোজগার করে এসব শিশু।
যে বয়সে তাদের বই নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসার কথা। সেই বয়সে তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে জীবিকা নির্বাহ করছে।
কক্সবাজারের কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টেই বেশিরভাগ পর্যটকদের উপস্থিতি দেখা যায়। এ পর্যটকদের ওপরই নির্ভর করে কক্সবাজারের শত শত শিশুর জীবিকা। সমুদ্র সৈকতের কলাতলী ও লাবণী পয়েন্ট ঘিরেই প্রায় শত শিশুর জীবন কাহিনী গড়ে উঠেছে।
এই সৈকতই তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। এসব শিশুর পরিবারে শিক্ষার সুযোগ না থাকা, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ও আর্থিক অনটনের রোষাণলে পড়ে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টি কাটিয়ে দিচ্ছে এখানে। সংসার নামক জীবনের খেয়ায় দাড় টানার দায়িত্ব এখন তাদের ঘাড়ে। ফলে অন্ধকারময় জীবন পাড়ি দিচ্ছে এসব শিশু।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১টা পর্যন্ত এ সৈকতেই ঘুরে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে তারা। আবার অনেকে সন্ধ্যার পর এখানে আসে। থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। তারাও পড়ালেখা করতে চায়। কিন্তু সেই সুযোগ-সুবিধা তাদের নেই। তাই এ সৈকতের সঙ্গেই তাদের জীবিকার সেতুবন্ধন।
রিফাত হোসেন(৯), বাড়ি সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি লাইট হাউস এলাকায়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে রিফাত সৈকতে আসে। পর্যটকদের হাত-পা ও মাথা ম্যাসাজ করে যা অর্থ পায়, তা দিয়েই চলছে তাদের সংসার ও পড়ালেখার খরচ। বাবার স্নেহ-ভালবাসা পায়নি কখনো। জন্মের পর বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র। রাত ১টার দিকে মা এসে রিফাতকে বাড়ি নিয়ে যায়।
বড় হয়ে লেখাপড়া করে পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে শিশু রিফাত। সে জানায়, আধা ঘণ্টা ম্যাসাজ করলে ২০ টাকা পাই। একটি গান গাইলে ১০ টাকা ও একটি সূরা তেলাওয়াত করলে ১৫ টাকা নেই। প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা পাই। তবে সব পর্যটকরা সমান টাকা দেয় না। অনেকে ঘোরায়। আবার অনেকে বকা দেয়।
রায়হান (১১), গুনাপাড়া এলাকায় বসবাস করে। বাবা নেই। বাবা জীবিত আছে কিনা সে জানে না। চতুর্থ শ্রেণি পাস করে স্কুলের পাঠের সমাপ্তি হয়েছে। অর্থের জন্য পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারেনি শিশু রায়হান। সমুদ্র সৈকতই তার ভবিষ্যত জীবনের সব কিছু নির্ভর করছে।
মিজান (১০), লাইটে হাউসে থাকে। বাবা নেই। সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসে। রাতে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটে বাড়িতে চলে যায়। সে পর্যটকদের মাথা, হাত-পা ম্যাসাজ করে। প্রতিদিন ৫/৬ জনের কাজ করে সে। সেই সঙ্গে ভালো আঞ্চলিক গান শুনিয়ে পর্যটকদের মন জয় করে অর্থ উপার্জন করে সে। সে পড়ালেখা করে না। প্রথম শ্রেণি পাস করে অর্থাভাবে সে আর স্কুলের গণ্ডিতে যেতে পারেনি।
লাইট হাউসের আমির উদ্দিন জালাল শাহ(৭)। সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। সারাদিন পড়ালেখা করে সন্ধ্যায় সৈকতে আসে। সে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। তার মাও সারাদিন বাইরে কাজ করেন। রাত ১টায় মা এসে তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।
সোনিয়া (৯)। বাবা নেই। পর্যটকদের কাছে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করে। সে একটি ডিম ১৫ টাকায় বিক্রি করে। কোনোদিন ১০/১৫টি, আবার কোনোদিন ৫/৬টি ডিম বিক্রি হয়। তাছাড়া সে ভালো বাংলা গান গাইতে পারে। পর্যটকদের গান শুনিয়েও সে অর্থ উপার্জন করে। উপার্জনের পুরো টাকাটাই রাতে বাড়িতে ফিরে মায়ের হাতে তুলে দেয়।
এসব শিশুরা সমুদ্র সৈকতে সিদ্ধ ডিম, পটোটো ক্রাকার্স, পানির বোতল ও শামুকের গয়না বিক্রি করে। এছাড়া তারা পর্যটকদের হাত-পা ও মাথা ম্যাসাজ এবং গান ও সূরা শুনিয়ে অর্থ উর্পাজন করে জীবিকা নির্বাহ করে। রাতে বাড়ি যাওয়ার সময় সৈকতে পড়ে থাকা প্যাকেট, খালি বোতল ও ময়লা আর্বজনা তারা নিজ নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা সারা দিনরাত এখানে অবস্থান করে পর্যটকদের সেবা করে কিছু অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে। শিশু মিজান বলে, পুলিশ আমাদের দেখলে মার দেয়। এখানে নিষেধ আছে ম্যাসাজ, গান শুনানোর বিষয়ে। এখানে পর্যটকদের কাছ থেকে চুরি করে অন্যরা। দোষ হয় আমাদের। তাই আমরা বেশিরভাগ সময় সন্ধ্যা হলে আসি।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৫
পিসি/