ফুলছড়ি (গাইবান্ধা) থেকে ফিরে: রাতে পুলিশি পাহারা দেখতে অভ্যস্ত গ্রামের লোকজন। কিন্তু এখানে দিনেই পুলিশ পাহারা দিতে হয়।
আর দিনের পুলিশের পাহারা সেও সুখকর নয়। পুলিশ চলে চব্বিশ হর্সের(অশ্বশক্তির) শ্যালোচালিত নৌকায়। আর সন্ত্রাসীরা চলেন ৪২ হর্সের নৌকায়। যে কারণে ডাকাতি শেষে পুলিশের সামনে দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যান সন্ত্রাসীরা। পুলিশ কাউকে ধরতে পারছে না। ডাকাত যাওয়ার পরে দেখা মেলে পুলিশের- এ কথা এখানে বহুল প্রচলিত।
ব্রহ্মপু্ত্র নদীর বালাসী-বাহাদুরাবাদ (তিনখোপা) ঘাটের চিত্র এটি। গাইবান্ধা ও জামালপুরের মধ্যে অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম ঘাটটি। ভীষণ রকম খেয়ালি প্রকৃতি এখানে নদীকে ক্রসচিহ্ন বানিয়ে দিয়েছে। চারদিকে যতোদূর চোখ যায় কোনো জনবসতি নেই। শুধু ধু-ধু বালুচর।
ব্রহ্মপুত্রের একটি ধারা দক্ষিণে ফুলছড়ি থানার টেংরাকান্দি, একটি উত্তরে গোলাবাড়ি ও পশ্চিম দিকের ধারাটি খাটিয়াবাড়ি (তালতলা বাজার), অন্যটি দেওয়ানগঞ্জের দিকে বহমান। নৌ-ডাকাতি এখানে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বিকেল ৫টার পর তুলে নেওয়া হয় পুলিশি পাহারা। আর পুলিশ চলে গেলেই শুরু হয় ডাকাতি। যে কারণে পুলিশ যতোক্ষণ থাকে (সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা) ততোক্ষণ পর্যন্ত থাকে নৌকা চলাচল। বিকেল থেকে ভোররাত পর্যন্ত এলাকাটি ‘সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য’ হিসেবে পরিচিত।
দিনের আলোই যেখানে ভরসা, সেই দিনেও ডাকাতের গতির কাছে অসহায় পুলিশ। গতি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে পুলিশের। রয়েছে দ্রুতগতি সম্পন্ন স্পিডবোটও। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে সেগুলো ব্যবহার করতে পারছে না পুলিশ। নৌকায় দৈনিক ২০ থেকে ৩০ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়, যাতে গড়ে খরচ হয় ১ হাজার ৯৫০ টাকা। অার স্পিডবোট ব্যবহার করলে দৈনিক দেড় থেকে দুইশ’ লিটার অকটেন/পেট্রোলের প্রয়োজন হয়। যার মূল্য প্রায় ২০ হাজার টাকা।
জ্বালানির জন্য এতো টাকা বরাদ্দ নেই। যে কারণে স্পিডবোট থাকলেও নৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেওয়ানগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসলাম হোসেন।
বালাসী-ফুটানিরবাজার(বাহাদুরাবাদ) খেয়া পারের মাঝি রেজা মিয়া বাংলানিউজকে জানান, বিকেল ৫টা পর্যন্ত থাকে পুলিশের পাহারা। এরপর এ নদীতে কোনো নৌকা চলাচল করে না। কেউ যদি এক লাখ টাকাও দেন, তবুও নৌকা নিয়ে বের হতে চান না মাঝিরা।
রেজা মাঝির নৌকায় থাকা এক নারী খানিকটা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কি সব অলক্ষুণে কথা বলেন’? ডাকাতের কথা আলোচনা করলেই ডাকাত চলে আসবে এ ভয়, না-কি শঙ্কার কথা মনে করতে চান না, বোঝার উপায় নেই।
ওই নারীর নাম মরিয়ম বেগম। আদি নিবাস মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে। কয়েক দশক আগে স্থায়ী নিবাস গড়েছেন গাইবান্ধায়। তার মেয়ে পড়েন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে, তাকেই দেখতে যাচ্ছিলেন মরিয়ম। পারাপারের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা তুলতেই নীরব হয়ে যান। সবার মধ্যেই যে চাপা ভীতি কাজ করছে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
বেলা ১২টা ২০ মিনিটে বালাসী থেকে ছেড়ে যাওয়া নৌকাটির মাঝি রেজা মিয়া নিজেও একবার ডাকাতির কবলে পড়েছিলেন। সে ঘটনার বর্ণনায় তিনি জানান, বিকেলবেলা নদী পার হচ্ছিলেন। দূরে একটি নৌকা দেখতে পান। তাতে মাত্র দু’জন লোক বসা ছিলেন। তার দিকেই নৌকাটি এগিয়ে আসছিলো। নৌকাটির গতিবিধি দেখে তার সন্দেহ হয়। সঙ্গে সঙ্গে গতি বাড়িয়ে দেন। আর টহল পুলিশের নৌকার মাঝিকে ফোন দেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাকে অনুসরণ করা নৌকাটি কাছাকাছি চলে আসে। আর তখন প্রায় ১৪ জনের মধ্যে মতো দেখতে পান। আগে তারা নৌকায় শুয়েছিলেন, যাতে কেউ বুঝতে না পারেন।
রেজা মিয়া জানান, তখন তার আর বুঝতে বাকি থাকে না। বাড়িয়ে দেন নিজের নৌকার গতি। তাকে অনুসরণ করা নৌকাটি এরই মধ্যে আরও কাছে চলে আসে। পেছনের নৌকার গলুইয়ে থাকা একজন তাকে বারবার থামানোর জন্য হুমকি দিচ্ছিলেন। তাদের কয়েকজনের হাতে ছিল রিভলবার। কিন্তু নৌকা না থামিয়ে গতি বাড়িয়ে দেন রেজা মাঝি।
আর তখন পেছন থেকে লম্বা বৈঠা দিয়ে তার মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করেন। মাথা বাঁকা করে আঘাত থেকে রক্ষা পান তিনি। ঠিক ওই সময় বিপরীত দিক থেকে একটি নৌকা আসতে দেখে ডাকাতরা নৌকা ঘুরিয়ে চলে যান।
বিপরীত দিক থেকে আসা নৌকাটিতে একটি ফ্লাগের মতো ছিল। যা সাধারণত টহল পুলিশের নৌকায় টানানো হয়। ওই নৌকাটি ছিলে পিকনিকের। তাতে বাঁশের মাথায় ছিল ফেস্টুন। আর ফেস্টুনকে ফ্ল্যাগ মনে করে পালিয়ে যান ডাকাতরা। সে যাত্রায় রক্ষা পায় রেজা মিয়ার নৌকা। তারপর আসে টহল পুলিশ।
কেন এতো ঝুঁকি নিলেন? ডাকাতরা যদি ধরে ফেলতেন তাহলে কি হতো! রেজা মিয়া বলেন, ‘ধরা দিলে প্রথমেই তারা এসে দু’তিন জনকে চোট মারেন (ধারালো অস্ত্র দিয়ে) অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য। তখন যাত্রীদের রক্ষা ছাড়া আর কিছুই মাথার মধ্যে ছিল না। আর যেহেতু আগেই পুলিশকে ফোন দিয়েছিলাম, ধারণা ছিল, কিছুক্ষণ সময় যদি ঠেকাতে পারি, তাহলে পুলিশ চলে আসবে’।
বালাসী থেকে ছেড়ে আসার ৩০ মিনিট পর (কাবিলপুর) দূরে একটি নৌকা দেখা যায়। তীরে ভেড়ানো নৌকাটিতে বাঁশের মাথায় ফ্ল্যাগ জাতীয় কিছু একটা টানানো অনুমান করা যায়। কিন্তু স্পষ্ট দেখা যায় না।
এতোক্ষণ নৌকায় গুমোট ভাব ছিল। পুলিশের নৌকা দেখে সবাই যেন স্বস্তির নি:শ্বাস নিলেন। যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেন। আর পানের ডিব্বা খুলে কাঁচা সুপারি দিয়ে এক খিলি মুখের মধ্যে পুরে দিলেন মরিয়ম।
এর বিশ মিনিট পর আবার নৌকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। শুধুই ইঞ্জিনের শব্দ। রেজা মাঝি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে প্রশ্ন করে জানা গেলো, ‘এটাই সেই ডাকাতি পয়েন্ট’।
** বাহাদুরাবাদ-বালাসী ঘাট: অচিহ্নিত-অনিরাপদ অদ্ভুত এক নৌ-রুট!
** যে গ্রামে ৯০ শতাংশ বাল্যবিয়ে
** স্যার এবারের মতো...
** ট্রেনের এপার-ওপার
** সুখির পরিচয় এখন রশিদের বউ
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৫
এসআই/এএসআর