গাজীপুর থেকে ফিরে: জনবল সংকটে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) সমন্বিত কেন্দ্রীয় বাস মেরামত কারখানাতে নষ্ট হচ্ছে শতকোটি টাকার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি। বিআরটিসি’র পরিবহন মেরামত করতে জাপান থেকে আনা হয় এসব যন্ত্রপাতি।
গাজীপুরের নাগোরপাড়ায় কারখানাটিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ৫টি সেকশন (বিভাগ)। সেগুলো হলো- ফুয়েল পাম্প সেকশন, হাল্কা মেরামত সেকশন, ভারি মেরামত সেকশন, গিয়ার বক্স সেকশন ও ইঞ্জিন মেরামত সেকশন।
সেকশনগুলোর প্রতিটিতে পড়ে রয়েছে জাপান থেকে আনা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। যা দিয়ে দিনে দু’টি ভাঙাচোরা পরিবহন মেরামত করে সম্পূর্ণ নতুনরুপে বের করা সম্ভব। অথচ কারখানাটিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোর কোনোই ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে জনগণের টাকায় আনা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অযত্ন আর অবহেলায়।
সূত্র জানিয়েছে, জাপান থেকে ১৯৮২ সালে এসব যন্ত্রপাতি নাগোরপাড়ার কারখানায় আনা হয়। এ যন্ত্রপাতিগুলো আনতে ১শ’ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কারখানাটি সচল ছিল। এরপর বন্ধ হয়ে যায় মেরামতের কাজ। ফলে ১৯৯২ সালের পর থেকেই অলস পড়ে রয়েছে শতকোটি টাকার যন্ত্রপাতিগুলো।
সূত্রটি জানায়, ১৯৮২ সালে যখন মেরামত কার্যক্রম শুরু হয়, সে সময় কারখানাটিতে ৩ শিফটে ৬শ’ লোক কাজ করতেন। পুরোদমে চলতো পরিবহন মেরামতের কাজ। ১৯৯২ সালে এসে বন্ধ করে দেওয়া হয় কারখানার মেরামত কাজ। এ সময়ও কারখানাটিতে প্রায় ৩শ’ জন কর্মরত ছিলেন। আর বর্তমানে কারখানাটিকে যেন পাহারা দেওয়ার কোনো লোক নেই। নামমাত্র নিরাপত্তাকর্মীসহ মোট জনবল আছেন মাত্র ১১ জন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় ১০ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা মেরামত কারখানাটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পরিবহনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। সেই সঙ্গে ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে মেরামত যন্ত্রপাতিগুলোও। অবশ্য বেশ চকচকে আছে মেরামতের মূল যন্ত্রপাতিগুলো। তবে তা চালানোর মতো কোনো মানুষ নেই। ফলে জনমানবহীন কক্ষের মধ্যে নীরবেই দাঁড়িয়ে আছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলো।
কারখানা সূত্র জানায়, মেরামতের জন্য আসা ৫০টি বিআরটিসি’র বাস কারখানার ভেতরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে আছে ২৩টি ভলভো দ্বিতল বাস, ১০টি মিনি স্টেক বাস, ৩টি ভারতের শোক লিল্যান্ড দ্বিতল বাস, ১৬টা চীনের ফাও বাস এবং ৪টি টিসি ও টাটা বাস। মেরামত না করে ফেলে রাখার কারণে শতকোটি টাকার বেশি মূল্যের এ ৫০টি বাসের সবগুলোরও অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে।
তবে প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট ও আর্থিক বিনিয়োগ করা হলে এ কারখানার মাধ্যমে বাসগুলো আগের মতোই নাগরিক সেবা দিতে সক্ষম হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মী জানান, মেরামত যন্ত্রপাতিগুলো কাজে লাগালে এখনো দিনে দু’টি ভাঙাচোরা বাসের সম্পূর্ণ নতুন রুপ দেওয়া সম্ভব। কারখানাটি চালু করা হলে সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা পবে। এজন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া। এতে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি সৃষ্টি হবে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান।
তিনি বলেন, আমরা বার বার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উল্টো কারখানার ভেতরে একটি অংশ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে পরিবহনের টায়ার বানানোর জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এতে কারখানার ভেতরে বাইরের লোক প্রবেশ করায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি খোয়া যাচ্ছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, কোনো দেশেই সরকারের আওতায় রেখে সেবামূলক কার্যক্রম সফলভাবে করা সম্ভব হয় না। রক্ষণাবেক্ষণ বা সেবা দেওয়া সরকারের কাজ না। সরকারের কাজ হলো শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ করা। তাই এ ধরনের (পরিবহন) সেবামূলক কাজে বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করা উচিত।
তিনি বলেন, প্রজেক্ট করার জন্য আগ্রহী মানুষ পাওয়া যায়। কিন্তু এটিকে ধরে রেখে সেবা দেওয়ার মতো মানসিকতা সরকারি লোকের থাকে না। যারা কাজ করেন, তারা নির্ধারিত বেতন পান। যতো কাজই করুন, তারা বাড়তি সুবিধা পান না। ফলে কাজের প্রতি তাদের দরদও থাকে না।
‘যে কারণে তাদের মানসিকতা থাকে মেশিন বিক্রি করা অথবা মেশিন নষ্ট করে নতুন প্রজেক্টের কাজ করা। এ ধরণের একটি দুষ্টচক্রে সরকার পড়ে আছে। যতোদিন সরকার এ দুষ্টচক্র থেকে বের হতে না পারবে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ হবে না’- বলেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, এ ধরনের সেবা বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ, বেসরকারি খাতে মালিক লাভের আশায় সার্বক্ষণিক কর্মীদের দিয়ে কাজ করান। আর যিনি যতো কাজ করেন, তিনি ততো বেনিফিট পান। যে কারণে বেসরকারি খাতে এসব সম্পদের সঠিক ব্যবহার সম্ভব হয়।
প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যন্ত্রপাতিগুলো কাজে না লাগানোর ফলে একদিকে যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবহনও নষ্ট হচ্ছে। মূল বিষয় হলো, সরকারি কর্মকর্তা কখনোই চাইবেন না, জনগণের টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে দরদ দিয়ে পরিবহন রক্ষণাবেক্ষণ করতে। এতে তাদের কোনো লাভ হবে না। তারা চাইবেন, নতুন নতুন প্রজেক্ট আনতে। আর নতুন প্রজেক্ট তখনই আনা সম্ভব হবে যখন আগেরটা নষ্ট হয়ে যাবে।
বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, গাজীপুরের কারখানায় জাপানের যে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলো এখন কাজে লাগছে না। কারখানাটিতে টুক-টাক মেরামতের কাজ করা হয়। তবে যে গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো আমরা মেরামত করতে চাই না। কারণ, এসব গাড়ি একটি মেরামত করতেই ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা খরচ হবে।
তিনি বলেন, যখন ভলভো গাড়িগুলো আনা হয়, সেই সময় গাড়ির যন্ত্রগুলো এনে বাংলাদেশে অ্যাসেম্বিল করে গাড়ি ফিট করা হয়। এখন আর সেই কাজগুলো নেই। এখন টুক-টাক মেরামতের কাজ রয়েছে। এ মেরামতের কাজের জন্য আমাদের ওই প্রযুক্তির দরকার নেই। আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন প্রযুক্তিগুলো কাজে লাগানো হবে।
** বিআরটিসি-১: কোটি টাকার ২৩ ভলভো ভাগাড়ে!
** বিআরটিসি-২: সড়কে সংকট, ডিপোতে জঞ্জাল!
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৫
এএসএস/এমআইএস/এএসআর