পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ের সদ্য বিলুপ্ত কোটভাজনি ছিটমহলের এক সময়ের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান মহেশ চন্দ্র সরকার (৯০)। নিজের ১৮ বিঘা জমি বিক্রি করতে দেরি হওয়ায় শেষ দফায় গেলেন ভারতে।
এক সময় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার কোটভাজনি ছিটমহলের রাজা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।
বয়সের ভারে নূজ্য সরকার সাহেব দেশ ত্যাগের সময় বাংলাদেশে রেখে যাওয়া ছয় মেয়ের কাঁধে ভর করে গাড়িতে উঠলেন।
এ সময় ছয় মেয়ের বুক ফাটা কান্না আর আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠের আকাশ-বাতাস।
ছোট মেয়ে মায়া রানী বাবার গলা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমাদের আর বাবা বলে ডাকার কেউ থাকল না। বাবা বেঁচে থাকতেও আমরা আজ এতিম হয়ে গেলাম। এ সময় তিনি বলেন, তুমি যদি চলেই যাবে তাহলে আমাদের বাংলাদেশে বিয়ে দিয়েছিলে কেন?
মহেশ চন্দ্র সরকারের ছয় মেয়ে ছয় ছেলের মধ্যে মেয়েদের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে। আর ছেলেদের মধ্যে চার ছেলে ২৬ নভেম্বর তাদের মাকে নিয়ে পারি দিয়েছেন ভারতে।
আজ ছোট ছেলে রতন চন্দ্রকে নিয়ে ভারতে যাচ্ছেন মহেশ সরকার। শুধু মেঝো ছেলে নিত্যচন্দ্র রয়ে গেলেন এদেশে।
পঞ্চগড়ের অধূনালুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের তিনটি ছিটমহল থেকে শেষ দফায় ১০টি পরিবারের ২৬ জন নতুন ভারতীয় নাগরিক ভারত গেলেন।
সোমবার (৩০ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার কোটভাজনি, দহলা খাগড়াবাড়ি ও বেহুলাডাঙ্গা ছিটমহলের নতুন ভারতীয়রা দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠের চেকিং ও লোডিং পয়েন্ট থেকে একটি বাস ও দু’টি ট্রাকে মালামালসহ ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন।
২৬ নভেম্বর সর্বশেষ এ ২৬ জন ট্রাভেল পাসধারীদের ভারতে যাওয়ার কথা থাকলেও জমি-জমা বিক্রি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তাদের পঞ্চম দফায় ভারতে যেতে হলো।
এর আগে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার এ ২৬ জনের জমি কিনে নেয়।
২৯ নভেম্বর বিকেলে ১০টি পরিবারের ৭ একর জমির ৫২ লাখ ৫১ হাজার ৬০ টাকা তাদের হাতে টাকা তুলে দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন।
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ গোলাম আজম ও দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সফিকুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সেকশন অফিসার শৈলেন্দ্র কিশোরের কাছে ২৬ জন নতুন ভারতীয় নাগরিকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ হস্তান্তর করেন।
এ সময় কান্নার রোল পড়ে জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া এ নতুন ভারতীয়দের স্বজনদের মাঝে।
২২ ও ২৩, ২৪ ও ২৬ নভেম্বর চার দফায় পঞ্চগড় সদর, বোদা, দেবীগঞ্জ উপজেলার ১০টি ছিটমহল থেকে ৪৫২ জন ভারতে যাওয়ায় এ নিয়ে পাঁচ দফায় পঞ্চগড়ের সদ্য বিলুপ্ত ১০টি ছিটমহল থেকে ৪৭৮ জন নতুন ভারতীয় নাগরিক নিজ দেশে ফিরে গেলেন।
পরে জেলা প্রশাসন, বিজিবি ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যানবাহন, মালামালসহ তাদের নিয়ে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া বিজিবি বিওপির পথে রওনা দেন।
দুপুরে ডাঙ্গাপাড়া বিওপির বিজিবি নতুন ভারতীয়দের ভারতের খালপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প ও কোচবিহার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করবেন।
নতুন ভারতীয়দের গ্রহণ করতে ভারতের কোচবিহার প্রশাসন চিলাহাটি-হলদিবাড়ী সীমান্তে ভারতের খালপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প ও বাংলাদেশের ডাঙ্গাপাড়া বিজিবি ক্যাম্প এলাকার নোম্যান্স ল্যান্ডে ১৫০ গজের একটি নতুন রাস্তা তৈরি করেছেন।
এছাড়াও ভারতীয় বিএসএফ তাদের সীমানার অভ্যন্তরে একটি তোরণ ও মঞ্চ তৈরি করেছেন।
চলতি বছরের ৬ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত জনগণনায় পঞ্চগড় জেলার সদ্য বিলুপ্ত ৩৬ ছিটমহলের ৪৮৭ জন ছিটমহলের নাগরিক ভারতে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন।
জনগণনার পর দেবীগঞ্জ উপজেলার কোটভাজনি ছিটমহলে একটি ও দহলা খাগড়াবাড়ি ছিটমহলে তিনটি নবজাতকের জন্ম হওয়ায় ভারতে যাওয়ার মোট সংখ্যা ৪৯১ জনে দাঁড়ায়।
তবে ভারতীয় ট্রাভেল পাস পাওয়া ৪৯১ জনের মধ্যে ১৩ জন ভারতে যাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৫
আরএ