ঢাকা: ‘অবশ্যই পারবো, আমরাই পারি! সমাজকে পরিবর্তন করে আলোর পথে নিয়ে যেতে আমরাই পারবো। ’
প্রত্যয় আর অবিচল স্বপ্ন নিয়ে এভাবেই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের ছাত্রী সাদিয়া তুন রাস্না ইতি।
শুধু ইতি-ই নন, তার মতো আরও শ’কয়েক তরুণ-তরুণীর চোখে-মুখেও এমই স্বপ্ন খেলা করছে।
গত ২৭ নভেম্বর গাজীপুরের মৌচাকের জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্টুডেন্ট চেঞ্জ মেকার সম্মেলনে গিয়ে এমনটাই দেখা গেল।
‘আমারাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট’ তিন দিনব্যাপী (২৬-২৮ নভেম্বর) এ চেঞ্জ মেকার সম্মেলনের আয়োজন করে।
এতে দেশের ৪৮টি জেলার ৯৫ জন তরুণ-তরুণী অংশ নেন। গাজীপুরের উঁচু-নিচু লাল মাটির পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের শপথ নিয়েছেন তারা।
সকালের হালকা কুয়াশা ভেদ করে আসা অগ্রহায়ণের মিষ্টি রোদে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে শালবনের ভেতর থেকে ‘আমরাই পারি’ আওয়াজ তুলে চারদিকে জানান দিচ্ছেন চেঞ্জ মেকাররা।
চেঞ্জ মেকার সম্মেলনে যোগ দেওয়া সাদিয়া তুন রাস্না ইতি জানালেন, তার পরিবার অনেকটা রক্ষণশীল। ছেলেদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া তো দূরে থাক, কারও সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই অন্য দৃষ্টিতে দেখতো পরিবার।
কিন্তু সেখান থেকে অনেক সংগ্রাম করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছেন তিনি।
তার ভাষায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বাড়ি যাবো, গাবতলী বাস টার্মিনালে বাবা অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ওইদিন ছিল হরতাল। হল থেকে টার্মিনালে একা যেতে বেশ ভয় লাগছিল’।
‘তখন এক সহপাঠীকে হেল্প করতে বলি। সে আমার সঙ্গে টার্মিনাল পর্যন্ত দিয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি বাবা। ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী পর্যন্ত পুরো রাস্তায় আমার সঙ্গে কথা বলেননি তিনি’।
‘এরপর বাবা বাড়ি গিয়ে বড় বোনকে বলেন, তখন বিষয়টি আমি তাদের বুঝিয়ে বলি। এরপর থেকে অনেকটা লিবারেল হয়েছেন তারা। আমার ভাইদের মতো আমার প্রতিও তাদের বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। এখন আমার কথার মূল্য দেন তারা’।
চেঞ্জ মেকার সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হলে ‘আমরাই পারি’র পক্ষ থেকে একটি ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। সেটা দেখে আমি বেশ উদ্দীপ্ত হই। এভাবেই চেঞ্জ মেকার হয়ে যাই।
চেঞ্জ মেকার হয়ে কোনো পরিবর্তন করেতে পেরেছেন কি-না? এমন প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলেই শুরু করলেন নিজের পরিবার দিয়ে।
‘আমার বোনের প্রাইমারি স্কুল পড়ুয়া একটি মেয়ে আছে। বয়স অল্প হলেও স্বাস্থ্য ভালো হওয়ায় বেশ বয়সী মনে হয়, গায়ের রং-ও কালো। এ নিয়ে আমার বোন বেশ চিন্তিত। তাই তিনি মেয়েটিকে খাবার কম দিতেন, বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহার করতে চাপ প্রয়োগ করতেন’।
‘বিষয়টি শোনার পর আমি তাকে বলি, মেয়েটির সঙ্গে এ ধরনের আচরণ না করতে। কেননা, এমন আচরণ করলে নিজেকে বেশ ছোট ভেবে হীনমন্যতায় ভুগবে সে। বোনও বিষয়টি উপলব্ধি করে এখন আর এমন করেন না’- একটানা বলছিলেন ইতি।
বেশ প্রত্যয় নিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি আমাকে চেঞ্জ করতে পেরিছি, ফ্যামিলিকে পেরেছি, সমাজকেও পারবো। অবশ্যই পারবো’।
তার সঙ্গে যোগ করে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র ইমতিয়াজ খান জীবন বললেন, ‘উই ক্যান’ আমাদের মধ্যে বীজ বপণ করা হয়েছে, তা দিনে দিনে অনেক বড় হচ্ছে। সমতার ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠা করবোই আমরা।
২০০৮ সাল থেকে চেঞ্জ মেকার সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর থেকে পরিবর্তনশীল কর্মী হিসেবে নিজের এলাকায় অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছেন তিনি।
বললেন, সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। পরে না অন্যের পরিবর্তন।
‘স্বপ্ন তো সবাই দেখে, আমরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই না। স্বপ্নের তাড়নায় ঘুমুতে চাই না। বাস্তবায়ন করে দেখা চাই, আমরাই পারি,’ - যোগ করেন জীবন।
চেঞ্জ মেকার হিসেব নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, গ্রামে ৮ম শ্রেণির এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে শুনে ওই বাড়িতে তা বন্ধ করতে যাই। কিন্তু মেয়ের বাবাসহ অভিভাবকরা বেশ বাজে আচরণ করছিলেন।
এক পর্যায়ে আমরাই পারি’র জিনাত আপার (জাতীয় সমন্বয়কারী) সহযোগিতায় প্রশাসনের লোকজন নিয়ে বিয়েটি বন্ধ করি। মেয়েটি এখন কলেজে পড়ছেন। পাশাপাশি একটি স্কুলেও চাকরি করেন। তার পরিবারের সদস্যরা প্রথমে রাগারাগি করলেও এখন বেশ ভালোভাবে তাকে সাপোর্ট করে।
চোখে পরিবর্তনের আলো ছিল ময়মনসিংহ থেকে আসা আসাদুজ্জামানের চোখেও। একদিন নিশ্চয়ই এ আলোতে আলোকিত হবে, দূর হবে নারী নির্যাতন।
‘আমি নাট্যদলে মুকাভিনয় করে সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করছি,’- নিজস্ব ভঙ্গিতে আসাদুজ্জামানের সহজ উত্তর।
এদিকে তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করে যারা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের একজন হলেন আমরাই পারি জোটের কো-চেয়ারপারসন এম বি আখতার।
তিনি বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিটি পরিবার কিংবা সমাজেই হয়। উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তদের বিষয়গুলো নজরে এলেও মধ্যবিত্তের নির্যাতনগুলো চোখে পড়ে না। শত কষ্ট হলেও তা প্রকাশ করতে চান না তারা।
তাই এটিকে ‘সামাজিক আন্দোলনে’ রূপ দিতে পারলে পারিবারিক নির্যাতন অনেক কমে যাবে। এক্ষেত্রে তরুণদের আরও বেশি এগিয়ে আসতে হবে।
এই তরুণ চেঞ্জ মেকারদের মধ্যেই ভবিষ্যতের নির্যাতনমুক্ত সমাজের চিত্র দেখতে পান আমরাই পারি জোটের জাতীয় সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক।
তিনি বলেন, ‘তরুণ-তরুণীরা এ সম্মেলন থেকে ফিরে নিজ নিজ এলাকায় নারী নির্যাতন রোধে কাজ করেন। নিজেকে পরিবর্তন করে পরিবার, সমাজ তথা দেশকে বদলে দিতে সম্মিলিত কাজে অংশ নেন তারা’।
দেশে এখন এই চেঞ্জ মেকারের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি জানিয়ে আমরাই পারি’র মিডিয়া অফিসার এ্যানি হামিদ জানান, এ সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে।
‘আমরাই পারি’ বিশ্বের ১৫টি দেশে পরিচালিত একটি গ্লোবাল ক্যাম্পেইন। বাংলাদেশে ২০০৪ সাল থেকে ৫৫টি জেলায় কাজ শুরু সংস্থাটি।
পরবর্তীতে ২০১১ সাল থেকে স্বতন্ত্রভাবে দেশে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে মানুষের মানসিকতা ও আচরণ পরিবর্তনে কাজ করে আসছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৫
এমএ/এএসআর