ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন মন্টুর পরিবার!

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৫
বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন মন্টুর পরিবার! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: দিনের পর দিন চোখের জলে বুক ভাসিয়েছেন। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন বিচারের।

কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও হয়নি বিচার। স্বামী হারানোর অসহ্য কষ্ট-যন্ত্রণা বয়ে বেড়ালেও এখনো সাজা হয়নি ইতিহাসের নৃশংসতম ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলাকারী জঙ্গিদের।

আর তাইতো বিচারের অপেক্ষায় ক্লান্ত রহিমা খাতুন রীনা ছেড়েই দিয়েছেন বিচারের আশা। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এ বিধবার স্বামী ছিলেন ময়মনসিংহ নগরীর ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মন্টু। ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর নগরীর অজন্তা সিনেমা হলে বর্বরোচিত বোমা হামলায় নিহত হন তিনি।

স্বামীর খুনিদের বিচারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শুকিয়ে গেছে চোখের জল। হৃদয়টাও হয়ে গেছে পাথর। যন্ত্রণা আর ক্ষোভ একাকার কন্ঠে রহিমা খাতুন রীনা বলেন, ‘এক যুগেও বিচার হয়নি। অহেতুক আশার বাণী শুনিয়ে আর কতোদিন। অনেক তো হলো। এ জীবনে আর বিচার পাবো না। বুকের কষ্ট তাই বুকেই চাপা দিয়েছি’।

ময়মনসিংহ নগরীর চামড়া গুদাম এলাকায় জীর্ণ একটি ঘরে ৩ সন্তান নিয়ে থাকেন রীনা। শনিবার (০৫ ডিসেম্বর) দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে আসেন। তবে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই যেন রাজ্যের আঁধার নেমে আসে তার মুখায়বে। বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনারা কতোই তো লিখলেন। কিছু হলো কী? আর লিখে কী করবেন?’

পাশেই দাঁড়ানো মেঝো পুত্র শাওয়াল হাসানের (১৫) চোখে-মুখেও মায়ের মতোই বিরক্তি। তবুও এগিয়ে এসে গেট খুলে দিলো। দুই কক্ষের জীর্ণ ঘরটিতে পা রেখেই বোঝা যায়, স্বামী হারানো স্ত্রী আর বাবা হারানো সন্তানরা কী নিদারুণ আর্থিক কষ্টে ভুগছেন।

রীনা জানালেন, এখন আর কোনো নেতাকর্মীও তাদের খোঁজ নেন না। রাজনীতিবিদ বা প্রশাসনের কেউ একটিবারের জন্যও দেখতে আসেন না। মন থেকে শান্তিও চিরদিনের জন্য উধাও হয়ে গেছে।

হাহাকার করে বলেন, ‘অজন্তা সিনেমা হলের মালিক বাবু ভাই আর আমার স্বামী ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাবু ভাইয়ের ডাকে একসঙ্গে চা খেতেই সেদিন মন্টু গিয়েছিলেন অজন্তা সিনেমা হলে। কিন্তু জঙ্গিদের বোমা অকালেই কেড়ে নেয় আমার স্বামীর জীবন’।

‘আমাকে ওরা বিধবা করলো। আমার সন্তানদের পিতৃহারা। অথচ এতো বছর পরেও এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিচার পেলাম না আমরা’- বলতে বলতে রীনার চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো অশ্রুবিন্দু। গড়িয়ে পড়লো অঝোরে।

আবারো ক্ষোভ নিয়ে বললেন, ‘তের বছর আগের দু:সহ স্মৃতি কেন মনে করিয়ে দিতে আসেন? প্রতি বছরই ০৭ ডিসেম্বরের আগে সাংবাদিকরা বাড়িতে ভিড় করেন। ইন্টারভিউ নেন। গত বছর ইচ্ছা করেই এজন্য বাড়িতে ছিলাম না। আমি চাই না, আমার স্বামী হত্যার বিচার’।

মায়ের কষ্টে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো মেঝো ছেলে শাওয়াল হাসানও। শাওয়াল এখন নগরীর মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। তাদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেলো প্রতিবন্ধী সন্তান তাওহীদ হাসানকে (১২)।

চরম দারিদ্র্যজর্জর জীবনে বেড়ে উঠছে নিহত মন্টুর সন্তানেরা। কোনোমতে টিকে আছে জীবন সংগ্রামে।

অবশ্য এ নিয়ে মোটেও আক্ষেপ নেই শাওয়ালের। শুধু কষ্ট এখন পর্যন্ত বাবার হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায়। কষ্টের দলা পাকানো ভারি তার কণ্ঠস্বর, ‘কয়েক মাস আগে মামলার হাজিরা হয়েছে। এখনো কোনো সুরাহা হলো না। বিচার হবে কি-না তাও বুঝি না। বিচারের অপেক্ষা করতে করতে আর ভালো লাগে না। সরকার শুধু দেশকে জঙ্গিদের হাত থেকে রক্ষা করুক। সবার মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হোক, আমাদের এর চেয়ে বড় আর কোনো দাবি নাই’।

২০০২ সালের ০৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ নগরীর অলকা, ছায়াবাণী, অজন্তা ও পূরবী সিনেমা হলে প্রায় একই সময়ে পৃথক বোমা হামলার ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হন। আহতদের মধ্যে যারা প্রাণে বেঁচে আছেন তারা এখনো অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।