স্বপ্নের সেতু। এই নামেই ডাকা হতো।
পদ্মার মাওয়া পার থেকে এক কিলোমিটার ভেতরে নদীর গভীরে সাত নম্বর পিলারের পাইল বসানোর মধ্য দিয়েই গতি পাবে এই কাজ। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোলিক হ্যামারের আঘাতে আঘাতে পাইলগুলো ঢুকবে নদীর তলদেশের অনেক গভীরে। সেই পাইল থেকে হবে পিলার। একেকটি পিলার যখন মাথা তুলবে নদীর বুক ফেরে তখনই স্বপ্নের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে সেতুর মুখ।
শনিবার দুপুর নাগাদ মাওয়া পাড়ে সেতু নির্মাণকাজের উদ্বোধনীফলক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুধুরই কাজ আর কাজ। ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ দেশবাসি পাবে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু। যা হয়ে উঠবে দেশের আশীর্বাদ। অর্থনৈতিক অগ্রগতির দৃঢ় সোপান।
দেশের ৪৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্পের নাম এই পদ্মাসেতু। আর তাই এতেই প্রধানমন্ত্রীর সর্বাধিকার। এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আবার সবচেয়ে বড় গর্বেরও, এই কারণে যে, নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছে পদ্মাসেতু নির্মাণ।
বিজয়ের মাস চলছে। আর মোটে চারটি দিন পড়ে দেশ উদযাপন করতে যাচ্ছে মহানমুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৫ বছর। ঠিক তার আগে পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন গোটা দেশবাসির জন্য আরেকটি বিজয়।
শনিবার সকালে সেতুর জাজিরা পয়েন্টে নদীশাসন কাজেরও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। সেতু সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেতু নির্মাণের কাজের পাশাপাশি এই নদী শাসন কাজটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই গুরুত্ব বিবেচনায় রেখেই প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে নদীতে পাথর ফেলে সেই কর্মযজ্ঞের উদ্বোধন করবেন।
দেড় দশকের স্বপ্ন
২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। সেসময়েও দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। তার হাতেই স্থাপিত হয় সেই ভিত্তিপ্রস্তর। এরপর ১৫টি বছর কাটিয়ে সেখানে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে নির্মাণ কাজের ফলক।
তবে তারও আগে ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি সম্পন্ন হয় শেখ হাসিনারই নির্দেশে।
এরপর থেমে থাকে সবকিছু। ভিত্তিপ্রস্তরে জমতে থাকে ধুলো ময়লা। বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার পদ্মাসেতুর কথা ভুলে বসে থাকে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে পদ্মাসেতু।
তবে পদ্মাসেতুর এই বাস্তবায়নের পথ মোটেই মসৃণ ছিলো না। জাতীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখে পড়তে হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে। ওঠে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগও। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দেশ আজ এক সত্যিকারের বিজয়ের পথে।
মোটেই দুই দিন আগে সেকথাই বলছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ১৯৭১-এ বিজয়ের নায়ক ছিলেন মহাবীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর পদ্মাসেতুর নির্মাণের মধ্য দিয়ে আরেক বিজয় নিশ্চিত করছেন বঙ্গবন্ধুর বীরকন্যা শেখ হাসিনা।
বলা হচ্ছে, এই পদ্মাসেতু আজ যে বাস্তবতা তা শেখ হাসিনার অসম সাহসিকতার সোনালী ফসল।
সংক্ষেপে বিশ্বব্যাংক উপখ্যান
২০০৯ সালে নিয়োগ করা কনসালট্যান্ট ২০১০’-এর সেপ্টেম্বরে প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করলে সরকারের সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র ডাকে। ২০ জুলাই ২০১০ তারিখে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ৫ জন দরদাতাকে প্রিকোয়ালিফাইড বিবেচনা করে প্রতিবেদন দেয়। ১০ অক্টোবর ২০১০ তারিখে বিশ্বব্যাংক নতুন করে প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র ডাকার অনুরোধ করে। সেতু বিভাগ সে অনুযায়ী আবারও প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র ডাকে। ২৪ নভেম্বরের মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র দাখিল করে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ৫টি প্রতিষ্ঠানকে প্রিকোয়ালিফাইড বিবেচনা করে ২০১১ সালের ০৭ জানুয়ারি প্রতিবেদন দিয়ে বিশ্বব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হয়।
বিশ্বব্যাংক ১ জুলাই অনাপত্তি দিলে ১৩ জুলাই সেতু বিভাগ থেকে মূল সেতুর বিড ডকুমেন্ট বিশ্বব্যাংকের সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। তখন থেকেই শুরু হয় নতুন খেলা। ওই ডকুমেন্টে বিশ্বব্যাংক সম্মতি না দিয়ে ২০১১’র সেপ্টেম্বরে সেতুর ঋণচুক্তি স্থগিত করে এবং পরে ঋণ চুক্তিটি বাতিলও করে দেয়।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু
একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এবং তারই ধারাবাহিকতা ২০১৩ সালের ২৬ জুন মূল সেতুর প্রিকোয়ালিফাইড ঠিকাদারকে বিড ডকুমেন্ট ইস্যু করা হয়।
২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে। যার ব্যয় ১২১৩৩.৩৯ কোটি টাকা। ইঞ্জিনিয়ার্স এস্টিমেট অনুযায়ী সর্বসাকূল্যে ১৩৮৮৫.৮৫ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এই আর্থিক প্রস্তাব যাচাই বাছাই করে। যাচাই বাছাইয়ে দেখা যায় চায়না মেজর ব্রিজের দেয়া প্রস্তাবে সরকারি প্রস্তাবের নির্ধারিত ব্যয় থেকে শতকরা ১২ দশমিক ৬২ কম দিয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এই প্রস্তাব গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে। মূল সেতু নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদের দাখিল করা আর্থিক প্রস্তাবটি ২০১৪ সালের মে মাসে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে আলোচিত হয় এবং ১২১৩৩.৩৯ কোটি টাকার অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০১৪ সালের জুন মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২৬ নভেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী কাজের মেয়াদ রাখা হয় ৪৮ মাস। সেই হিসেবেই ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্পন্ন হবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
পদ্মার বিশালতার মতোই বিশাল
পাঁচটি প্রধান প্যাকেজে ভাগ করে কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কাজ ১৫০ কোটি ডলার (প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা) ব্যয়ে মূল সেতু নির্মাণ। আর ১০০ কোটি ডলার (প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা) ব্যয়ে নদী শাসন। সঙ্গে রয়েছে তিনটি অপেক্ষাকৃত ছোট প্রকল্প। যার মধ্যে অন্যতম অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ। মাওয়া অংশে কেবলই সড়ক, তবে জাজিরা অংশে সড়কের পাশাপাশি আরও পাঁচটি সেতু নির্মাণের কাজ অনেকাংশেই সম্পন্ন হয়েছে।
৪২টি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে থাকবে ছয় কিলোমিটারের বেশি লম্বা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেতু। এছাড়া দেড় কিলোমিটার করে উভয়পাড়ে তিন কিলোমিটার সংযোগ সেতুর জন্য আরও ২৪টি পিলার হবে। সেতুর ৪২টি পিলারে ছয়টি করে ২৪০টি এবং দুপারের ১২টিতে দু’টি করে ২৪টি পাইল বসাতে হবে। সর্বমোট ২৬৪টি পাইল বসবে। সেই চ্যালেঞ্জিং কাজ পাইল ড্রাইভিংয়ে সূচনা করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার মধ্য দিয়েই শুরু হবে নির্মাণযজ্ঞ। প্রমত্ত পদ্মার পানির ভেতর দিয়ে তলদেশের অনেক গভীরে প্রথিত হবে একেকটি পাইলের ভিত। তার থেকেই বের হয়ে আসবে পিলার। আর সেই পিলারের উপর বসবে মূল সেতু। যাতে কেবল সড়কই নয় থাকবে রেল পথও। দেশ এগিয়ে চলবে উন্নয়নের পথ ধরে দূর বহুদূর।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
এমএমকে