ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

চুকনগর গণহত্যা-৪

বাবাসহ পরিবারের ৮ সদস্যের মৃত্যু দেখেছি পাটিতে লুকিয়ে

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
বাবাসহ পরিবারের ৮ সদস্যের মৃত্যু দেখেছি পাটিতে লুকিয়ে ছবি: মানজারুল ইসলাম, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনার ডুমুরিয়ার চুকনগর বধ্যভূমি ও বটিয়াঘাটা থেকে ফিরে: ‘চারদিকে গুলি আর বারুদের গন্ধ। প্রাণভয়ে মানুষ সেদিন পুকুরে, ডোবায়, ভদ্রা নদী, এমনকি গাবগাছ, মসজিদ, কালীমন্দির, কালীবাড়ির বটের শেকড়ের নিচে বড় গর্তে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু পাকিস্তানি হায়েনারা বাঁচতে দেয়নি। অতর্কিত হামলায় আমার বাবাসহ পরিবারের আট সদস্য ও মুক্তিকামী ১০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে’।

শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) বটিয়াঘাটার ডাউনিয়াফাঁদ গ্রামের নিজ বাড়িতে চুকনগরের ভয়াবহ সে গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন শহীদ অভিনাশ গাইনের ছেলে নিতাই গাইন (৬৮)।

মুক্তিযুদ্ধকালে নিতাই গাইন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহকারী। তিনি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি প্রথমে খুলনা বেতার কেন্দ্র এলাকায় যুদ্ধ করি’।

নিতাই গাইন জানান, পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠী জীবন বাঁচানোর তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাদের মধ্যে ছিলেন আমার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন। তারা বটিয়াঘাটার ডাউনিয়াফাঁদ গ্রাম থেকে গিয়েছিলেন।

‘ভারতে যাওয়ার জন্য সবাই ট্রানজিট হিসেবে বেছে নেন ডুমুরিয়ার চুকনগরকে। ১৯৭১ সালের ১৯ মে রাতে সবাই চুকনগরে এসে পৌঁছান। সাতক্ষীরা ও কলারোয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে তারা ভারতে যেতে চান। সেখানে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না। চুকনগরের পাতোখোলা বিল, কাঁচাবাজার চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, কালীমন্দিরসহ বিভিন্ন শ্মশানে আশ্রয় নেন তারা। সারা রাত নির্ঘুম রাত কাটে। পরদিন (২০ মে) সকালে বিশ্রাম সেরে ভাত রান্না শুরু করেন অনেকে। কেউ চিড়ে-মুড়ি ও অন্য শুকনো খাবার দিয়ে শরীরে চলার শক্তি সঞ্চার করে নিচ্ছিলেন’।

‘সকাল ১০টার দিকে তিনটি ট্রাকে করে পাকিস্তানি সেনারা চুকনগর বাজারের ঝাউতলায় (তৎকালীন পাতখোলা) এসে থামে। তাদের সঙ্গে ছিলো হালকা মেশিন গান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। সাদা পোশাকে মুখঢাকা লোকজনও আসে’।

নিতাই গাইন বলেন, ‘ওইদিন আমাকে ঘটনাস্থলের একটি মসজিদের বারান্দায় বাড়ির পাশের এক নারী পাটি দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। আমি পাটির ফাঁক দিয়ে দেখেছি, পাকিস্তানিরা কীভাবে একে একে গুলি করে মানুষ হত্যা করে। শহীদদের মধ্যে ছিলেন আমার বাবা ছিলেন অভিনাশ গাইন, চাচা বাদল গাইন, চাচাতো ভাই রঞ্জিত গাইন, চাচাতো ভাইয়ের ছেলে বিনয় গাইন, চাচাতো ভাই (ঈশ্বর গাইন), ফুফুর স্বামী অধর মণ্ডল, ফুফাতো ভাই ধীরেন মণ্ডল ও চাচি মালতী গাইন’।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘গণহত্যার পর আমি পাশের নদীতে মরদেহ আর রক্তের স্রোত দেখেছি। যে স্রোতে ভেসে আছে নারী, বৃদ্ধ, শিশু। সর্বত্র মরদেহের স্তূপ। কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। নদীর পাশ দিয়েও অনেক মরদেহ, নদীতেও। রক্তে চারদিক লাল হয়ে গেছে’।

তিনি বলেন, ‘তখন আমি পূর্ণাঙ্গ যুবক। কিন্তু করার কিছুই ছিলো না। শুধু বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছি। গুলিবিদ্ধ অনেকেই তখনো বেঁচে। অথচ সেবা নেই, চিকিৎসা নেই। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অসহায়ভাবে’।
তিনি জানান, এই গণহত্যার পাশাপাশি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী নারীদের ধর্ষণ করে। এছাড়াও অনেক বাঙালিকে পাশের পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে পরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। আবার যারা আহত হয়েছিলেন, তাদের বর্বর পাকিস্তানিরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা যে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার এক নীরব সাক্ষী নিতাই গাইন বলেন, ‘অনেক শিশু মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিলো, সে অবস্থায় চলে ঘাতকের কামান। ঘাতকের বুলেট মায়ের বুকে বিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মা। কিন্তু অবুঝ শিশু তখনও অবলীলায় মায়ের স্তন মুখের মধ্যে রেখে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে’।

ক্ষোভ প্রকাশ করে শহীদ পরিবারের এ সন্তান বলেন, ‘যেসব মানুষের তাজা রক্তে বাংলার স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছিল, যাদের আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সেই মহান শহীদ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ৪৪ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকুও পাননি। যাদের মধ্যে আমিও একজন’।

চুকনগরের প্রথম শহীদ চিকন আলী মোড়লের ছেলে এরশাদ আলী মোড়ল (৭২) বাংলানিউজকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে স্বাধীন দেশে পাইনি কোনো স্বীকৃতি। নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও পাইনি কোনো সনদ’।

তিনি জানান, মাত্র ২শ’ গজ দূরে তার বাবাকে গুলি করে পাকিস্তানি বাহিনী। সেখানেই মারা যান তিনি। এরপর পুটিমারির ঋষিপাড়ার দিগম্বরসহ আরও কয়েকজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
এমআরএম/এএ/এএসআর

** মাটি খুঁড়লে এখনও মেলে কঙ্কাল
** ‘রক্তের স্রোতে লাশ ভাসতি দেহিছি’
** অরক্ষিত বধ্যভূমি, নেই গণহত্যার নামফলক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।