ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ভাত বেচে মেয়েকে অনার্স পড়াচ্ছেন মালেকা

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৬
ভাত বেচে মেয়েকে অনার্স পড়াচ্ছেন মালেকা ছবি: শাকিল / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: স্বামী করেন রাজমিস্ত্রির জোগালের কাজ। প্রতিদিন কাজ থাকে না বলে তার আয়ে সংসার চলে না, রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।

এর মধ্যে চার ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ তো আছেই। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় ভাত বিক্রি করে বাড়তি আয়ের পথ বেছে নিয়েছেন জীবন সংগ্রামী নারী মালেকা বেগম।

রাজধানীর রাজউক এভিনিউয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের সামনের ফুটপাতে প্রতিরাতে নিয়ম করে ভাতের দোকান নিয়ে বসেন তিনি। যা চলে প্রায় পুরো রাতভর। ঠিক দোকান বলতে যা বোঝায় তা নয়! একটি বড় সাইজের ভাতের পাতিল, কয়েকটি তরকারির পাত্র। সঙ্গে একটি গ্লাস আর কয়েকটি থালা।

একটি পানির ব্যারেল রাস্তার ওপর রেখে ফুটপাতে বসে যান ভ্রাম্যমাণ ভাতের হোটেল নিয়ে। কাস্টমারও কম নয়, সন্ধ্যার পর থেকেই ছিন্নমূল মানুষ, নিম্ন আয়ের লোকজন এখানে খাওয়া-দাওয়া করেন।

বুধবার (২০ জানুয়ারি) দিনগত রাত দেড়টার দিকে কথা হয় মালেকা বেগমের সঙ্গে। জানালেন, প্রায় ছয় বছর ধরে এই জায়গায় প্রতিরাত ‘ভ্রাম্যমাণ হোটেল’ নিয়ে বসেন। পুরোপুরি বিক্রি না পর্যন্ত সেখানে বসে থাকেন। এতে অনেক সময় রাত ৩ টাও বেজে যায়। আর ত‍ার হোটেলে খেতে আসেন রিকশাওয়ালা, ছিন্নমূল মানুষসহ বিভিন্ন অফিস বা ভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা।

আলাপ-চারিতায় মালেকা জানান, তার হোটেলে প্যাকেজেও খাবার চলে। এর একটি প্যাকেজের আওতায় আছে-এক প্লেট ভাত-ডিম মিলে ৩০ টাকা, ভাত-মাছ ৩০ টাকা, ভাত-বট (গরুর ভুরি) ৩০ টাকা। তবে ভাত-মুরগী ৪০ টাকা আর ভাত-গরু ৫০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। এক্ষেত্রে প্রথমবারের পর প্রতি অতিরিক্ত প্লেট ভাত বিক্রি করেন  ৫ থেকে ১০ টাকায়। আর পানিতে কোনো টাকা নেওয়া হয় না, যা আশেপাশের কোনো ওয়াসার পাম্প থেকে আনা হয়। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এভাবে প্রতি রাতে এক হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে ৩-৪শ’ টাকার মতো লাভ থাকে।

‘স্বামী যা রোজগার করে তা দিয়া বাসা বারাই অয় না। আমার এহান থাইক্যা নিজেগোর খাওয়া আর পুলা-মাইয়াগো লেহাপড়ার খরচ চালাই,’ বলেন আনুমানিক ৪৫ বছর বয়সী মালেকা।

কথার ফাঁকে ফাঁকেই ক্রেতাদের খাবার পরিবেশন করছিলেন তিনি। এরমধ্যে এক ক্রেতা অর্ডার করলেন খাবারের। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে তাকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। খাবার বেড়ে দেওয়া থেকে শুরু করে পরিবেশন সবই একহাতেই সামলাচ্ছেন। গায়ে শীতের চাদর জড়ানো থাকলেও কাঁপছিলেন। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার কথা তুলতেই এই শীতের কাঁপুনি উপেক্ষা করে তার মুখে হাসি ঝড়লো। হাস্যজ্জল মুখে নিজ থেকেই বললেন, ‘আমি মুর্খ। পোলাপাইনগুলান পড়ালেহা করলে বালাই। অগো জন্যেই তো কষ্ট করতাছি। ’

মালেকার তিন মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে মিরপুরের একটি কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়ছেন। তবে কলেজের নাম বলতে পারছিলেন না। তার ভাষ্য, ‘মিরপুর ১ নম্বরের কি একটা কলেজ আছে ওইটায় অনার্সে পড়ে। ’ বাংলা কলেজ কি-না? এমন প্রশ্নে মালেকা বেগমের উত্তর, ‘এমনই হইবে। ’ ‘মাইয়াডাই বড়। এরপর পুলা, এইবার আইএ দিবো, রাজারবাগ পুলিশ লাইন থাইক্যা। তার ছোড মাইয়া ম্যাট্টিক দিবো। আর সবার ছোড মাইয়া থিরিতে পড়ে। ’

তবে ছেলে-মেয়েদের নাম জানতে চাইলে তাদের নাম বলতে রাজি হননি এই সংগ্রামী মা।   রাতে ফুটপাতে মায়ের ভাত বিক্রির খবর প্রকাশ হলে ছেলে-মেয়েদের সম্মানহানি হবে- হয়তো এই ভেবে তাদের নাম বলেননি। তাই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে কিছুটা সহজ করা গেল।

মালেকা বেগম জানান, শৈশব থেকে রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় থাকেন তারা। তাদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা হোটেলে, বাসায় কাজ করে তাদের চার ভাই-বোনকে বড় করেছেন। এরই মধ্যে একই এলাকার ছেলে মোহাম্মদ মরম আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। অন্য দুইবোন ও ভাইও বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তবে সুনামগঞ্জেই থাকেন তারা।

‘এই জায়গায় ৬ বছর ধইরা পত্যি রাতেই ভাত বেচি। কোনোদিন ভয় লাগে নাই, কোনো ধরনের সমস্যাও অয় নাই,’ বলেন মালেকা।

বাংলাদেশ সময়: ০৬১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৬
ইইউডি/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।