ঢাকা: বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল ২৩২ কোটি টাকার, মিলেছে ৬০ কোটি। তাও পড়েছে ছাড় বিলম্ব জটে! সব মিলিয়ে অর্থের অভাবে ম্লান হতে চলেছে পর্যটন বর্ষের যাবতীয় ঢাক-ঢোল পরিকল্পনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ সালকে ‘পর্যটন বর্ষ’ ঘোষণা ও সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজালেও সুফল আসছে না আশানুরূপ। টাকার অভাবই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে বছরের প্রথম মাস থেকে।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা এমনটাই জানালেন।
কর্মকর্তারা জানান, ২৩২ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে হিসেব পাঠানো হয়। মাত্র ৬০ কোটি টাকা পাশ করেছে কমিশন। কিন্তু সে টাকারও
কোনো ছাড় হয়নি।
সূত্রমতে, বুধবার (২০ জানুয়ারি) বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাধ্য হয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অর্থ ছাড়ের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
রাশেদ খান অর্থমন্ত্রীকে বলেছেন, আপাতত ৫ কোটি টাকা ছাড় দিলে প্রচারণার কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়। অর্থমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেছেন, কিন্তু বাস্তবতা হল- চাইলেই দিনে দিনে অর্থছাড় সম্ভব নয়। এজন্যও অপেক্ষা করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, পর্যটন বর্ষ সফল করতে ২৩২ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে সুস্পষ্ট হিসেবই পাঠানো হয়েছিল।
সে হিসেবে বেশ কিছু ‘জিজ্ঞাসা’ দেখিয়ে ফেরত পাঠায় কমিশন। জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর জানাতেই বেশ কালক্ষেপণ হয়। সম্প্রতি নতুন হিসেব কষে কাগজপত্র পাঠালে তার ভিত্তিতে মাত্র ৬০ কোটি টাকা পাশ করে কমিশন।
টাকার অভাব প্রসঙ্গে পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের যে অর্থ প্রয়োজন, তা পেলে কাজগুলো আরও মনের মতো করে করতে পারতাম। যদিও টাকার জন্য কাজ থামিয়ে রাখিনি, যাবতীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবো আমরা।
তিনি বলেন, ‘বছরজুড়ে কী কী করবো- সেসব অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। উদ্দেশ্য পূরণে তাই এটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকা পাওয়ার আগ পর্যন্ত সবকিছু সীমিত পরিসরে করতে হচ্ছে’।
মন্ত্রী বলেন, শুধু পর্যটক বাড়ানো নয়, বাংলাদেশকে অন্যতম সেরা পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বিশ্বে অবস্থান তৈরি করতেই যাবতীয় উদ্যোগ। ক্যাম্পেইনকে সব’চে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
‘দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম, ফ্লাইটের ম্যাগাজিন, বিলবোর্ড, রোড-শো, আউটডোর মিডিয়া ক্যাম্পেইনসহ যা যা কার্যকর হবে বলে মনে হয়েছে, সব পরিকল্পনাই নিয়েছি। পর্যটকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা দিচ্ছি। বিভিন্ন জনপ্রিয় ইভেন্টের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি আমরা। কিন্তু সমস্যা একটাই- টাকার অভাব। ’
পর্যটনের এক কর্মকর্তা আত্ম-সমালোচনার সুরে বাংলানিউজকে বলেন, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ আগেই রাখা উচিত ছিল। একদিকে ঘোষিত বর্ষ চলছে, অন্যদিকে সাশ্রয়ের দিকে ভাবতে গিয়ে পরিকল্পনায় ছোট-বড় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। কিপটেমী করে এত বড় উদ্যোগ সফল করা যায় না।
‘প্রচারের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের। কিন্তু টাকা কোথায়? প্রচারণার জন্য আয়োজনগুলো হতে হবে আরও ঝলমলে। অথচ মুঠো সংযত রেখে রেখে কাজ করতে হচ্ছে আমাদের,’ বলেন তিনি।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১০ লাখ পর্যটকের সমাগমের টার্গেট রাখা হলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেই- এটা অস্বীকার করা যাবে না। ট্যুরিজম বোর্ড ৭৮০টি পর্যটন স্পট চিহ্নিত করেছে, কিন্তু গোছানো হয়নি সেগুলো।
এ বছর ৭ লাখ, আগামী বছর প্রায় ৮ লাখ ও ২০১৮ সালে ১০ লাখ পর্যটক আনতে চাই বলে আসছি সবাই, কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে নিজেরাই খুশি হতে পারছি না।
‘পর্যটন খাত থেকে ২০১৬ সালে ৯৮০ কোটি তিন লাখ টাকা, ২০১৭ সালে ১ হাজার ১৮২ কোটি ২৫ লাখ এবং ২০১৮ সালে ১ হাজার ৫৩২ কোটি ২৬ লাখ টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রা পাছে ‘হাস্যকর’ হয়ে না যায়, সেজন্য বিনিয়োগ করতে হবে। টাকা ছাড়া টাকা আয় হয় না’- বলেন তিনি।
টাকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে কর্মকর্তারা জানান, ‘ভিজিট বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে মূল আয়োজনে বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাড়তি সুবিধা থাকছে। দর্শনীয় স্থান ঘুরতে তারা হোটেল-মোটেলে বিশেষ ছাড় পাবেন। ছাড় পাবেন প্লেন টিকিটেও। ইলেকট্রনিক পেমেন্ট কার্ড, প্রিভিলেজড কার্ড এবং পর্যটন কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত সব হোটেল-মোটেলে ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা পাবেন তারা। আর এসব কিছুতেই টাকা লাগবে ছোট-বড় নানা অংকের।
তারা বলছেন, বছরের প্রথম মাসের (জানুয়ারি) প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে শেষ হয়েছে মেগা বিচ কার্নিভাল। ভালোই হয়েছে আয়োজন, কিন্তু আরও ভালো হতে পারতো। এরপর পর্যটন লোকজ মেলা, ফোক আর্ট মেলা, ঘুড়ি উৎসব। সবই খরচের ব্যাপার।
এছাড়া আগামী ২৫-২৭ জানুয়ারি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী মধুমেলা, ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী একুশে বই মেলা, ৬-৮ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জে হাছন রাজার জন্মবার্ষিকীতে তিনদিনের ‘হাছন উৎসব’, মাতৃভাষা দিবসে প্রভাত ফেরি, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
‘‘এরপর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সাভারের জয় রেস্তোরাঁয় ‘সেকালের গান উৎসব’, ৯-১৫ মার্চ কর্পোরেশনের বিভাগীয় হেড কোয়ার্টারে কনসার্ট, ১৭ মার্চ প্রমোশনাল প্যাকেজ ট্যুর হবে। এসব পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করছে অর্থছাড়ের ওপর,’’ যোগ করেন তারা।
২০২০ সাল নাগাদ সারাবিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ১৬০ কোটি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পর্যটকদের প্রায় ৭৩ শতাংশ এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণ করবে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। আর সেখানেই সম্ভাবনা দেখছিলেন বাংলাদেশের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশকে অন্যতম প্রধান গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল সে হিসেব কষেই। কিন্তু টাকার অভাব সম্ভাবনা এখন কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তায় ভাবছেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৬
এসকেএস/এমএ