জাতীয় সংসদ ভবন থেকে: নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনে সংসদে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। সেই ভাষণে সরকারের বিগত সময়ের কার্যক্রম ও আগামীর দিক-নির্দেশনামূলক বিষয়গুলো তুলে ধরেন তিনি।
কিন্তু নবম অধিবেশনের তৃতীয় দিনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে রাষ্ট্রপতির ভাষণ প্রত্যাখ্যান করেছেন ঝিনাইদহ-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য (এমপি) তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
সোমবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর প্রথমে বক্তৃতা দেন তাহজীব। শুরুতেই স্পিকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি রাষ্ট্রপতির ভাষণ প্রত্যাখ্যান করছি।
তিনি বলেন, অবশ্যই মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণে তথ্য আছে, সততা এবং বস্তুনিষ্ঠতা আছে, ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনাও আছে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রপতির ভাষণ অপরিপূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ। এখানে বরাবরের মতোই ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা প্রতিফলিত হয়নি। তাই ধন্যবাদ প্রস্তাবকে সমর্থন করতে পারছি না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে তাহজীব বলেন, বছরের প্রথম দিনে বই উৎসব করে ৩৩ কোটি বই বিতরণ সত্যিকার অর্থেই চমৎকৃত হওয়ার মতো একটি ব্যাপার। শুধু দেশে নয়, নিশ্চয় আন্তর্জাতিকভাবেও বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু বই বিতরণে সরকার যতটা সক্ষমতা দেখিয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আমরা সক্ষমতার সেই লক্ষণ দেখিনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দু’টি পাবলিক পরীক্ষার পরিবর্তে এখন চারটি পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে।
তিনি বলেন, শিক্ষার সামগ্রিক মান না বাড়লেও বাজারে নোটবুকের সংখ্যা বেড়েছে, একেবারেই অবুঝ ও নিষ্পাপ ছেলেমেয়েরা যেনতেন উপায়ে, পরীক্ষায় ভালো গ্রেড পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত চারদিকে শুধু গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ারই প্রতিযোগিতা। এটি যেন মেধা যাচাইয়ের একমাত্র মাপকাঠি। গোল্ডেন এ প্লাস দেওয়াও হচ্ছে উদারভাবে। কিন্তু এতসব গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীরা আদৌ কতটুকু সৃজনশীল হচ্ছে, কতটুকু উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য যোগ্য হচ্ছে? মানবিক মূল্যবোধই বা কতটুকু বিকশিত হচ্ছে এবং জীবনযুদ্ধে জীবিকা অর্জনের জন্য কতটুকু প্রস্তুত হচ্ছে? এর উত্তর গোল্ডেন এ প্লাসের সুবাতাসে যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে তাহজীব বলেন, ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ৬১৫১ জন এমবিবিএস ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে সরকার অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের রিক্ত, নিঃস্ব, দরিদ্ররাও এখন এমবিবিএস ডাক্তারদের সেবা পাচ্ছে। মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই সাধুবাদ দিতে হয়। তবে এই নবাগত এমবিবিএসদের পাঠিয়ে যদি মন্ত্রণালয় ভেবে বসে যে, তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, সেটা মোটেও ঠিক হবে না।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে সাহস এবং প্রত্যয় নিয়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছে, তা সত্যিকার অর্থে জাতি হিসেবে আমাদের গর্বিত করেছে। কিন্তু এই পদ্মাসেতুর বেলায় আমি একেবারে দরাজকণ্ঠেই বলছি, প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু দিয়ে সারা বিশ্বকে জানান দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ এখন আর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে, বন্যায় আক্রান্ত হয়ে দারিদ্র্যের ব্যবসা করে না। বরং নিজের অর্থ দিয়ে, গর্বিত জাতি হিসেবে, আগামী দিনের সোপান রচনা করবার জন্য দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় সম্পূর্ণ নিমগ্ন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, পদ্মা সেতুতে আমরা যেমন করে পারি, ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোর লেনে কেন সেভাবে পারলাম না বা পারি না? দিনের পর দিন কাজ বিলম্বিত হলো, ব্যয় বাড়ল, জনগণের দুর্ভোগও বাড়লো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির চাকা বজায় রাখতে গেলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিশ্ববাজারে আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি। অনেক কিছুর সঙ্গে দরকার সরকারের সৃজনশীল বাণিজ্য নীতি বা বাণিজ্য কূটনীতি। অথচ আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সফল বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে দেশীয় পণ্যকে বিদেশের বাজারে উন্মুক্ত করেছে- এমন নজির চোখে পড়েনি।
বিদ্যুতের উৎপাদন বিষয়ে তাহজীব বলেন, প্রতি মাসেই রেকর্ড ছুঁয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের উৎপাদন। লোডশেডিং নামক যন্ত্রণা নগরবাসী একেবারে ভুলেই যেতে বসেছে। এটি অবশ্যই সুসংবাদ। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত হলো- বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্রমান্বয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ওপরে নির্ভরশীলতা। আগে আমরা পানির জন্য ভারতের ওপরে নির্ভরশীল ছিলাম, ক্রমান্বয়ে আমরা বিদ্যুতের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। ভারত থেকে বর্তমানে ৫০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়ে জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। আরও ৫০০ মেগাওয়াট নেওয়া হবে বলে সরকার থেকে ঘোষণা এসেছে।
কৃষি নিয়ে স্বতন্ত্র এ সংসদ সদস্য বলেন, দেশে প্রতিবছরই কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। বাংলার কৃষক হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ফসল উৎপাদন করছেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কৃষকের দুর্ভোগও।
তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, ফসল যতোই বেশি, দাম ততোই কম।
পে-স্কেলের সমালোচনা করে তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, অষ্টম জাতীয় পে-স্কেলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে অভূতপূর্ব বেতনভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, তাতে প্রত্যাশিত ছিল যে, প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত হবেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করলাম, প্রজাতন্ত্রের কিছু কিছু অংশের লোক খুশি তো নয়ই, বরং দ্রোহের আগুনে পুড়ছেন। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা ইতোমধ্যে কর্মবিরতি পালন করেছেন। সমস্যাটি আসলে কোথায়? অর্থমন্ত্রীর ভাষায় জ্ঞানের অভাবে, নাকি অন্য কোথাও?
তিনি বলেন, মানুষের অপমানবোধকে আরও তাতিয়ে দিয়েছে কিছু মন্ত্রী-আমলার অযাচিত মন্তব্য। যাদের কাছে দায়িত্ব ছিল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিরসনের, তারা সমস্যাটিকে আরও জটিল থেকে জটিলতর করেছে। এছাড়া আজকের আমলারা, যারা সরকারের প্রতি অতি অনুগত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান, তারাই আবার পট পরিবর্তনে জাতীয়তাবাদী শক্তিতেও পরিণত হতে পারে। এটিই স্বাভাবিক। এটিই তো আমলাদের বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্র।
আর তাই তো আমলাদের অতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে যেন শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন না হয় সে বিষয়েও গভীর দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬/আপডেট ০৩৩৩ ঘণ্টা
এসএম/এইচএ/