রংপুর: নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে। রোকেয়ার জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে, মৃত্যু ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে।
১৯৯৭ সালে রোকেয়ার স্মৃতিরক্ষার্থে উদ্যোগ গৃহীত হয়। এখানেই কোনো এক স্থানে ছিলো তার আঁতুর ঘর। ধ্বংসপ্রায় বাড়িটির এই চার দেওয়ালের মধ্যেই ধর্মান্ধ সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্বসভায় অনন্য স্থান করে নিয়েছিলেন রোকেয়া। আজ এটি অরক্ষিত।
বেহাত হয়ে গেছে তার বাবা ভূ-স্বামী জহির উদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবেরের জমিদারির সাড়ে তিনশ’ বিঘা জমি।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ১ জুলাই এই স্মৃতি কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে পায়রাবন্দকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম পাদপীঠ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। কিন্তু ১২ বছরেও এর কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে পায়রাবন্দবাসী।
মিঠাপুকুরবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশে ৩ একর ১৫ শতক জমির উপর বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অথচ রোকেয়ার পৈত্রিক সম্পত্তিই ছিল সাড়ে তিনশ’ বিঘা। যা বিভিন্ন জন ভোগদখলে রেখেছেন।
২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় স্মৃতিকেন্দ্রটি বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করেন। প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জম্ম ও মৃত্যু দিবস ঘটা করে নানা আয়োজনের মধ্যে পালন করা হলেও বছরের অন্যান্য দিনগুলো থাকে উপেক্ষিত।
স্মৃতি কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-ফারুক বাংলানিউজকে জানান, কেন্দ্রটি খুলে দিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলেও খোলেনি এর বন্ধ দরজা। পায়রাবন্দে বাংলা একাডেমির বিভিন্ন শ্রেণির ১৩ জন কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে তারা বেতন-ভাতা না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন নবী বাংলানিউজকে জানান, এই পরিস্থিতিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্মৃতিকেন্দ্রটি ন্যস্ত করার প্রস্তাবনা জমা প্রদান করে মন্ত্রণালয়।
তিনি বলেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি ন্যস্ত করা হয় তাহলে রক্ষা পাবে কেন্দ্রটি।
পায়রাবন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. ফয়জার রহমান খান বাংলানিউজকে জানান, প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন, বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি রক্ষা পাবে।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দিনের আমলে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তাস্তর করা হয়। একই সালে ১৭ মার্চ অলিখিতভাবে স্মৃতিকেন্দ্রটি বিকেএমই’র শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুমতি দেন।
আবার শুরু হয় পোশাক তৈরির শ্রমিক প্রশিক্ষণ। এ প্রকল্পটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন সেনা প্রধান মইনউদ্দিন আহমেদ। স্মৃতি কেন্দ্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ায় বিকেএমইকে উচ্ছেদ করার নির্দেশ চেয়ে রিট করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ।
পায়রাবন্দ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল ২০১২ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
হাইকোর্ট স্মৃতি কেন্দ্রটির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও শ্রমিক প্রশিক্ষণ বন্ধের আদেশ দিলে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ২০১২ সালে ১ মে বিকেএমই কে উচ্ছেদ করেন।
শ্রমিক তৈরির কারখানা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্মৃতিকেন্দ্রর মূল কর্মকাণ্ড এখনো শুরু করা হয়নি। চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিশাল অবকাঠামো এখন ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কার্যক্রম না থাকায় স্মৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে।
দিনের বেলা আগত দর্শনার্থীদের ভীড়ে মুখরিত থাকলেও সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে তা পরিণত হয় বখাটে ও নেশাখোরদের আড্ডাখানায়। গভীর রাত পর্যন্ত চলে নেশাপান সহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যক্রম।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, যেদেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতা, মন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ পদে থেকে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই দেশে বেগম রোকেয়ার জন্মভূমিতে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু না হওয়ায় লজ্জাবোধ করছি।
মিঠাপুকুর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুন-অর-রশিদ বাংলানিউজকে জানান, বেগম রোকেয়ার পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চলছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন। কেন্দ্রটি খুলে দিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলেও কী কারণে চালু হচ্ছে না তা বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৬
এএটি/আরআই