নদী আছে জীবন আছে। নদী নেই- আমাদের জীবনও যেনো এক শুষ্ক মরুভূমি।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় বৈশাখে বাংলার নদীর যে রূপবর্ণনা করেছেন সে রূপ এখন বাংলার প্রমত্ত পদ্মা, মেঘনা যমুনায়ও দেখা যায়। ‘বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে’- হাটু জল এখন কেবল বাড়ির পাশের ছোট্ট নদীতেই নয়, মেঘনা-যমুনায়ও হাঁটু পানি দেখা যায়। বরিশাল থেকে ঢাকা নদী পথে আসার সময় হাঁটু জল দেখিনি সত্যি-কিন্তু মাঝে মাঝেই জেগে উঠেছে চর। যমুনাতো এখন এক জলশূন্য চর। ফি বছরই এখানে হাঁটু জল থাকে। আর ছোট ছোট নদীগুলো অস্তিত্বতো আজ প্রায় বিলিন।
একসময় নদীই ছিল আমাদের জীবন-জীবিকা ও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এখন সড়কের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে, কমেছে নদীর ওপর। এখন নদীর বুকে ভাসেনা সেই সব রঙ্গিন সাম্পান-নৌকা। যোগাযোগের বাহন হিসেবে নৌকা আজ আর নেই। যা আছে তা ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা। নদীর বুকে মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকাগুলো আজ আর খুব বেশি দেখা যায়না। যাবে কি করে? নদীতেতো মাছই নেই। জেলেরা নৌকা ভাসাবে কিসের আশায়? সবই যেনো আজ আশ্রয় নিয়েছে আমাদের সোনালী অতীতের খাতায়-পাতায়।
একসময় নদীর ওপর লঞ্চ বা ট্রলার চললে তার পেছনে দেখা যেতো শত শত শিকারি পাখির ছোটাছুটি। জলের বুকে ভেসে ওঠা মাছ ধরতেই তাদের এ ছুটে চলা। পাখিগুলো মাছের জন্য বহুদূর পর্যন্ত উড়ে যেতো। একটা দুইটা মাছ ধরতে পারলেই ফিরে যেতো নীড়ে। সেখানে আসতো নতুন পাখি। তারাও চলে যেতো। জীবনানন্দের কবিতায় নানা নামে গাঙচিলকে আমরা পাই। ঝাকেঝাকে সেই গাঙচিলগুলো আজ আর দেখা যায়না। মাঝে মাঝে শিকারের সন্ধানে উড়ে আসে একটি-দুইটি গাঙচিল, আবার ফিরে যায়। অথচ এসকময় নদীতে এদের ছিল অবাধ বিচরণ। নদীর সেই চিরচেনা রূপ আজ হারিয়ে গেছে।
এখন শুষ্ক মৌসুম। নদীতে তেমন স্রোতও নেই। বছরের এ সময়টাতে নদী শান্তই থাকে। ঢাকার পথে লঞ্চ চলতে চলতে মাঝে মাঝে দেখা মিললো কয়েকটি মালবাহী জাহাজ। মাঝ নদী দিয়ে অতি শান্ত ও ধীরগতিতে এগিয়ে চলছে গন্তব্যের দিকে। গন্তব্য কোথায় জানিনা। কিছুটা পথ পাশাপাশি চলা আর কি। সে ঢেউ আছড়ে পড়েছে দু’জনের গায়েই। তারপর মালবাহী জাহাজটি মিলিয়ে গেলো গোধূলী বেলার দূর কুয়াশায়। আমরা এগিয়ে চললাম লালকুঠির দিকে।
সূর্য তখন গাঢ় লাল। একটু বাদেই নীচের দিকটা ধীরে ধীরে দিগন্তে হারিয়ে যাবে। ডিঙ্গির কোনায় কোনায় জ্বলে উঠেছে কুপিগুলো। নৌকা খুব বেশি চোখে পড়লোনা। মাছ নেই, তাই জেলেও নাই, জালও নেই।
নদী আজ নি:সঙ্গ। তার বুকে মাঝি নেই, মাছ নেই, নেই গাঙচিলও। জীবনের সমস্ত জঞ্জাল আমরা নদীতে বিসর্জন দিয়েছি। নদীর ওপর চালিয়েছি দু:শাসন। সেই সাথে নিবির্চার মস্য ও জলসম্পদ আহরণে নদী আজ প্রাচুর্যহীন এক বহমান স্রোতধারামাত্র। এর বুকে জাল নেই, জেলে নেই, জল নেই। আছে শুধু জ্বালা। একবুক জ্বালা। অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা ও হারানোর বেদনা। নদীর বুকে সোনালী সূর্য আজো খেলা করে, কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে রূপালি ইলিশ। জীবনানন্দের নীল কস্তুরি আভার চাঁদ আজও জ্যোৎস্না ছড়ায়, কিন্তু হারিয়ে গেছে তার গাঙচিলগুলো। তবু হৃদয়ে বেজে ওঠে:
লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস!
ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাস
নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে
বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে!
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৭
এসএইচ