সড়ক-মহাসড়কে সব ধরনের পরিবহন এর শিকার হলেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পোশাক শিল্প। দালাল ও সোর্সদের মাধ্যমে তোলা বিপুল হারের এ চাঁদা পরিশোধে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিল্পাঞ্চলটির গার্মেন্টস কারখানা মালিকদের।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাস্তবেই আশুলিয়ার সর্বত্র চাঁদাবাজি যেন বৈধ রূপ পেয়ে গেছে। প্রতি মাসে এখানকার পরিবহন খাত থেকে প্রায় আট কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। এর মধ্যে থানা ও হাইওয়ে পুলিশ ১০টি পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে প্রতি রাতে ১০-১২ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে। ছয়টি স্পটে আশুলিয়া থানা পুলিশ ও চারটি স্পটে হাইওয়ে পুলিশ এ বখরা আদায় করে।
অন্যদিকে বাইপাইল মোড়ে হরদম চাঁদাবাজি চালান ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। এ পয়েন্ট থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে ট্রাফিক পুলিশ। বাইপাইল ট্রাফিক ফাঁড়ি থেকে মাসোহারা টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে দিনে তোলা হয় আরও দশ লাখ টাকা করে।
আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় চলা ১০ হাজার নিষিদ্ধ অটোরিকশা থেকে দৈনিক পুলিশি চাঁদা ওঠে ১০ লাখ টাকা। স্থানীয়ভাবে মাটি বহনকারী চলাচলের অনুপযোগী পাঁচ শতাধিক ট্রাক সচল রাখতে মাসিক তিন হাজার টাকা করে অগ্রিম চাঁদা পৌঁছাতে হয় থানায়। ফলে ভাঙাচোরা ট্রাক খাত থেকে প্রতি মাসে থানার নামে ১৫ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা ওঠে।
এসব ছাড়াও অবৈধ টার্মিনাল, সড়ক-মহাসড়ক দখল, চোরাই গাড়ি চলাচল, বাস-মিনিবাস-লেগুনা স্ট্যান্ড, দেড় শতাধিক পরিবহন এজেন্সি, শতাধিক কোচ কাউন্টারসহ অন্যান্য খাত থেকে মাসোহারা হিসেবে প্রতি মাসে আরও ৩০ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা পায় পুলিশ।
দিনভর সর্বত্র রেখে-ঢেকে চাঁদাবাজি চললেও রাতে চাঁদাবাজ পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় নামেন ডাকাতের ভূমিকায়।
রাতের আঁধার নামতেই পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের অসৎ নেতাকর্মী, নামধারী পরিবহন শ্রমিক নেতা, ভুয়া সাংবাদিক ও স্থানীয় পর্যায়ের মাস্তান-সন্ত্রাসীদের যৌথ সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ গ্রুপগুলো সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হয়। অতি ভয়ঙ্করভাবে রাতের আততায়ী হিসেবে চাঁদা তোলে কাঠ, বাঁশ, রড ও পোশাক পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও পিক-আপ ছাড়াও লেগুনা, দূরপাল্লার কোচগুলো থেকে। দিনের চাঁদাবাজির শিকার হয় বাস-মিনিবাস, মাইক্রো-প্রাইভেটকার, লেগুনা, অটোরিকশা, এমনকি মালামাল বোঝাই রিকশাভ্যানও।
মাসোহারা টোকেনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি চলে আশুলিয়া দিয়ে চলাচলকারী দুই সহস্রাধিক দূরপাল্লার কোচ, স্থানীয় ট্রাক, লোকাল বাস-মিনিবাস, লেগুনা, সিএনজি ও রেন্ট-এ-কারের প্রাইভেট-মাইক্রোতেও।
রাতভর বিরতিহীন চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে হৈচৈ, চিল্লাফাল্লা, ছোটাছুটি আর পুলিশের অবিরাম হুইসেলের শব্দে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ, চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানো চালকদের সারা রাত গাড়িসহ আটকে রাখা, চড়-থাপ্পড়-লাথি মারা, মিথ্যা সন্দেহের দোহাই দিয়ে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সব মালামাল নামানোসহ নানা ধরনের মামলার ভয়-ভীতি দেখানো হয়।
আশুলিয়া থানার পুলিশ সর্বোচ্চ অঙ্কের চাঁদা পায় শিল্পাঞ্চলের পণ্য বহনকারী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লং ভেহিকল থেকে।
ঢাকা ইপিজেডসহ আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল থেকে তৈরি পোশাক নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরগামী রওনা দেওয়া প্রতিটি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে পুলিশ বখড়া পায় এক হাজার টাকা করে।
গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানায়, হরতাল-ধর্মঘট না থাকলে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ও ঢাকা ইপিজেড থেকে পণ্য বোঝাই করে প্রতিদিন ছেড়ে যায় অন্তত ৬০০ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান। রফতানিমুখী এসব পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে প্রতিদিন থানার নামে বখশিশ-বখড়া হিসেবে তোলা হয় ছয় লাখ টাকা।
অন্যদিকে মেশিনারিজসহ কাঁচা মালামাল নিয়ে প্রতিদিন আট শতাধিক ট্রাক আসে আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে। এসব ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লং ভেহিকল কোনো কারখানা গেটে পৌঁছালেই চালকের পকেট থেকে ৫০০ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়। কারখানা গেটেই দৈনিক চাঁদাবাজি ঘটে প্রায় চার লাখ টাকার।
এ হিসাবে শিল্পাঞ্চল সংশ্লিষ্ট পণ্যবাহী যানবাহন থেকে থানা ও শিল্প পুলিশ প্রতি মাসে হাতিয়ে নেয় প্রায় তিন কোটি টাকা।
অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে দায়ের করা মামলাকে পুঁজি করে আশুলিয়া থানা পুলিশ গ্রেফতারের নামে চাঁদা বাণিজ্য চালাচ্ছে। ধার্যকৃত চাঁদা না দিলে ‘নাশকতা’র মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সেখানে শ্রমিক নেতাদের ধরপাকড় অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পুলিশ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কথিত নাশকতার মৌখিক অভিযোগ তুলছে। তাদের মাথাপিছু পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা ধার্য করে তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শিগগিরই এ দাবি পূরণ না হলে নাশকতার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে কঠিন শায়েস্তা করা হবে।
পুলিশের এমন হুমকি-ধমকিতে গার্মেন্টস কারখানা ঘেঁষা এলাকাগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। থানা পুলিশের রাত-দিন ছোটাছুটি আর মারদাঙ্গা দৌরাত্ম্যের মুখে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পর্যন্ত বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। পুরুষশূন্য বাড়িঘরেও রাত-বিরাতে আশুলিয়া থানা পুলিশ চড়াও হচ্ছে। বাড়িতে থাকা বিভিন্ন বয়সী নারীদের নানাভাবে ভীতি প্রদর্শনসহ হয়রানি চালানোরও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কথিত নাশকতার অভিযোগ তুলে পুলিশ ইতোমধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, অভিনেতাসহ অন্তত ৪০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয়েছে নিপীড়ন-নির্যাতন।
শ্রমিক অসন্তোষের ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ দু’টি ও কারখানা কর্তৃপক্ষ আটটি মামলা করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শ্রমিক নেতা, চেয়ারম্যান, অভিনেতা, সাংবাদিকসহ অন্তত ৪০ জনকে।
সব মামলায় কয়েকজনের নাম উল্লেখসহ সহস্রাধিক অজ্ঞাত শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। প্রতিটি মামলায় উল্লেখ করা ‘অজ্ঞাত’ আসামিদের ফাঁদটি জুতসইভাবেই ব্যবহার করছে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এখন প্রতিদিন ভোরে কারখানায় যোগদানকালে এবং রাতে ছুটির পর শ্রমিকরা বের হলেই পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। দর কষাকষি শেষে লেনদেন সম্পন্ন হলে রাতেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন ধরা-ছাড়ার বাণিজ্যে আশুলিয়া থানা পুলিশ প্রতিদিন গড়ে লক্ষাধিক টাকা কামিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফলে পুলিশি ধরপাকড়, হয়রানি ও ঘুষ-বাণিজ্যের ধকল থেকে রেহাই পেতে শত শত শ্রমিক আশুলিয়া ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কর্মবিরতি, ভাঙচুর বা আন্দোলনে অংশ না নিলেও তারা কারখানার কাজে অংশ নেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না।
আশুলিয়া থানার এসআই শাহাদাতের বাদী সেজে রুজু করা অপর মামলায় আসামি বানানো হয় সাংবাদিক নাজমুল হুদাকে। এ মামলাটির মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে পুলিশের মামলা-চাঁদা বাণিজ্যসহ নানা অনাচারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে না বললেই চলে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৭
এএসআর