তারেক রহমানকে এক সময় তারুণ্যের প্রতীক বলে মনে করত বিএনপি। তারুণ্যের জোয়ার তৈরি করা হলো।
সিনিয়রদের পান থেকে চুন খসলে বিএনপির উঠতি নেতারা তাদের মুণ্ডুপাত করেন। মিছিল করেন, স্লোগান দেন। মাস কয়েক আগে মওদুদ আহমেদের একটি বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতা রিজভী আহমেদ তার মুণ্ডুপাত করেছেন। তিনি কড়া ভাষায় মওদুদ আহমেদকে আক্রমণ করেছেন। বিএনপির সবচেয়ে শক্তিশালী থিংকট্যাংক মওদুদ আহমেদের জন্য তা অসম্মানজনক। তাকে এভাবে আক্রমণ সাধারণত অন্য সিনিয়রদেরও আতঙ্কিত করেছে। অবমূল্যায়িত হওয়ায় বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ দেখা যায়। সম্মানবিবর্জিত রাজনীতি করার চেয়ে নিষ্ক্রিয় রাজনীতি অনেক সম্মানের বলে তারা হয়ত সেই সম্মানজনক নীরবতার দিকে চলেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১৯ জন্য সদস্যের অধিকাংশই সক্রিয় নন। সাদেক হোসেন খোকা, মির্জা আব্বাস, তরিকুল ইসলাম, মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, নজরুল ইসলাম খান, ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, আর এ গনি বা অন্যান্য সিনিয়র নেতাকে রুটিন কাজ ছাড়া তেমন একটা দেখা যায় না। কালেভদ্রে হান্নান শাহ, গয়েশ্বর বা রফিকুল ইসলাম মিয়াকে দেখা যায়। তা-ও টকশোতে।
তরুণ নেতাদের একটি অংশ প্রচার করে থাকে, সিনিয়র নেতারা সরকারের পেইড এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। সরকারের কাছে থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে তারা দল থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। তরুণ নেতাদের অনেকেরই এসব প্রচারণার উদ্দেশ্য সৎ নয়। সিনিয়র নেতাদের কোনো পদ-পদবি খালি হলে তা দখলের তীব্র ইচ্ছা তারা মনের গভীরে পোষণ করেই এমন প্রচার বা অপপ্রচারে মাতেন।
সমকালে বিএনপির ভরাডুবির অন্যতম কারণ কিন্তু সিনিয়র নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা। বিএনপিতে স্থায়ী কমিটির নেতাদের গত কোন সময়ে ডাকা হয়েছে সেটাও মিডিয়া ভুলতে বসেছে। সিনিয়র নেতারা অনেক সময় জানতেও পারেন না সিদ্ধান্ত কোথা থেকে এলো। অধিকাংশ সময় খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান নিজেই সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের দাবিতে বিএনপি বিভিন্ন সময় বহুমুখি আন্দোলন সংগ্রাম করলেও দল হিসেবে বিএনপিতে গণতন্ত্র প্রায় অনুপস্থিত। দলে গণতন্ত্র-চর্চার অভাব বিএনপিকে দুর্বল করেছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপিতে দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপক ক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে সেটা করুণ অবস্থায় পৌঁছেছে। দলীয় প্রধান ছাড়াও যে স্থায়ী কমিটি নামে একটা নীতিনির্ধারক ফোরাম আছে সেটি অনেকেই জানে না বা ভুলে গেছে। শুধু দলীয় প্রধানই নন, তাঁর পুত্র তারেক রহমানও সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন প্রবাসে বসে ফোনে, ভাইবারে, হোয়াটস অ্যাপে। পাশাপাশি খালেদার অফিস স্টাফরা সিদ্ধান্তদাতার তালিকায় রয়েছেন। গণতন্ত্রহীনতার চর্চায় অফিস স্টাফরাও অনেক সময় নিজেদের সিদ্ধান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে চাপিয়ে দিচ্ছেন—এমন কথাও শোনা যায়।
আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে গেলে তার অফিসের স্টাফরা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাসায় ঢুকতে না দেওয়ার স্পর্ধা দেখান। মওদুদ আহমেদ মিডিয়াকে বলেছেন, এটা নিয়ে তাদের কারও সঙ্গে আলোচনা করা হয় নি। খালেদা জিয়া যেহেতু সেদিন ঘুমাচ্ছিলেন সেহেতু তিনিও সিদ্ধান্ত দেন নি। তাহলে শিমুল বিশ্বাসের এক সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করা হলো? বলা হয়ে থাকে, শিমুল বিশ্বাসরাই এখন বিএনপি চালাচ্ছেন। এর দিনকয় আগেই বিজেপিপ্রধান অমিত শাহ খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন মর্মে আরেক অফিস স্টাফ মারুফ কামাল খান বিবৃতি দিয়ে বসেন। পরদিনই অমিত শাহের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, “ইয়ে সব বকোয়াস হ্যায়”।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, বিএনপি চালাচ্ছে কারা তার অনুসন্ধান। বিএনপি একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, এর দলীয় গঠনতন্ত্র রয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী স্থায়ী কমিটিই বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরাম, সেখান থেকেই সব সিদ্ধান্ত আসার কথা। দলীয় যে কোনো স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক সময়ে স্থায়ী কমিটির সব নেতা বসে পারস্পরিক শলা পরামর্শের মাধ্যেমে যৌক্তিক কৌশল নির্ধারণ করবেন, গণতান্ত্রিক দলগুলোর ক্ষেত্রে এটাই সব সময় হয়ে আসছে। পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যথোপযুক্ত ও উত্তম সিদ্ধান্তটি বেরিয়ে আসে। বিএনপি সেটা ভুলে গিয়েছে। সেটা হচ্ছে না বলেই গণতান্ত্রিক স্রোতধারায় বিএনপি বারবার হোঁচট খাচ্ছে। দলীয় সিদ্ধান্ত নিতে হলে টেবিলে বসতে হবে। যে দলের প্রতিটা সিদ্ধান্ত একজনের কাছ থেকেই আসে, সে-দল "ওয়ান ম্যান পার্টি" হয়ে যায়।
-মনোয়ার রুবেল, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট
ইমেইল-monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
** বিএনপি ডুবছে কেন?