বিএনপি কিছু অদ্ভুত জিনিসে বিশ্বাস করে; সেসবের একটি হলো যারা আওয়ামী লীগের বন্ধু, তারা বিএনপির শত্রু। সদ্য-বিলুপ্ত বিএনপির ওয়েব সাইটে বিএনপির নীতি আদর্শে লেখা ছিল:
বিএনপি আদর্শ আওয়ামীলীগের বিরোধিতা করা।
১৯৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির বড় কৌশল ছিল ভারত বিরোধিতা। ১৯৪৭ এ দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে হিন্দুবিরোধী রাজনীতি মুসলিম লীগ শুরু করেছিল স্বাধীনতার পরেও তা থেকে বেরুতে পারেনি পাকিস্তান । ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত মুসলীম লীগের অ্যান্টি হিন্দু রাজনীতি অ্যান্টি ইন্ডিয়ায় রূপ নেয়। বাংলাদেশে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ ও এর সমমনা ব্যক্তিরা এতে অন্তর্ভূক্ত হতে শুরু করেন। তারা এমন একটি দলের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলেন অনেকদিন। জিয়াউর রহমানের এদের নিয়ে প্রথমে ফ্রন্ট এবং পরে বিএনপি নামে একটি দল তৈরি করেন। তাদের সাথে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিও বিএনপিতে প্রবেশ করে। বহুদলীয় রাজনীতির নামে জামায়াতকে পুন: প্রতিষ্ঠা করা হলে জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাওয়ায় ওদের দ্বিতীয় জন্মের ঋণ তৈরি হয়; এবং জিয়াউর রহমানের বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞতার বাহুডোরে আবদ্ধ হয়। আদর্শগতভাবে আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরোধিতা করা, ইসলামের হুজুগ তোলা, বহুবিধ কারণে জামায়াতে ইসলাম বিএনপির প্রতি গভীর মমত্ববোধ অনুভব করে।
বিএনপির বর্তমান ভরাডুবির পেছনে ভারতবিরোধী ভুল রাজনীতি একটি মূল কারণ। গেলো বার জেদের বশবর্তী হয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে খালেদা জিয়ার দেখা না করা শিষ্টাচার বহির্ভূত তো বটেই; দল হিসেবে বিএনপির অপরিপক্ক রাজনীতির প্রমাণ রেখেছে। দেখা না করার শিক্ষা বিএনপি পেলেও তা থেকে কিন্তু তারা কোনো দীক্ষা নেয় নি। আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও দেখা না করার রাজনীতি বিএনপি করেছে। বিএনপিকে কে বা কারা বুদ্ধি দেয় যে, দেখা না করলে প্রণব মুর্খাজী বা শেখ হাসিনার উচিত শিক্ষা হবে, সেটা বহু চেষ্টাও করেও বুঝতে পারিনি।
বিএনপির আরেকটি বড় সমস্যা হলো বিএনপি দল হিসেবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতি ঠিক করতে পারে নি। তারা দেশের ভেতরে যেমন আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনীতি করে, আন্তার্জাতিক পর্যায়েও আওয়ামী লীগের বন্ধুদের বিরোধিতা করার রাজনীতি করে। কখনো কখনো আওয়ামী লীগের আন্তার্জাতিক বন্ধুরা বাংলাদেশের ভালো বন্ধু হয়ে থাকে। বিএনপি তাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরোধিতা করে ফেলে।
বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো দল থাকে না। তারা তখন শুধুই বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে থাকেন, সেটা বিএনপি ভুলে যায়। প্রায়ই বিএনপি বিদেশি মেহমানদের কাছে আওয়ামী লীগের নামে নালিশ করে। ১৯৯৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশে এলে তার কাছে বিএনপি বিশাল ফর্দ তুলে বিচার দিয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি এলেও সরকারের বিরুদ্ধে একগাধা অভিযোগের লিস্ট নিয়ে হাজির হয়েছিল। যদিও সময়াভাবে মনের সব কথা খুলে বলার সুযোগ হয়নি। কিন্তু বিএনপি আশা করে বিদেশিদের কাছে নালিশ করলে তারা এসে সরকারকে ঝেটিয়ে বিদেয় করে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবে। এটা নিশ্চয়ই তারা বিশ্বাসও করে। তা না হলে এমন কাজ করছে কেন? বিএনপি বেশিরভাগ সময় এবং শক্তি ব্যয় করে বিদেশি লবিংয়ে। বিদেশি কোনো এমপি কী বলল, বা কোন এমপির কাছ থেকে দস্তখত নিয়ে কোন বিবৃতি দেয়া যায়, সেটা নিয়ে বিএনপির বড় একটি অংশ তৎপর থাকে। এবং এটা করতে গিয়েই তারা জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে। অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভর রাজনীতি দেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়েছে। দেশের মানুষের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণার তৈরি হয়েছে, বিএনপি বিদেশি-প্রভুভক্ত দল। যদিও বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ করে এসেছে এতদিন।
ভারতবিরোধী হিসেবে বিএনপি ও তার সমমনারা ভারতের কাছে আওয়ামী লীগ দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে, ভারত ফেনী পর্যন্ত দখল করে ফেলছে, র-এর লোক ঢুকে হেফাজতে ইসলামীর সমাবেশের আড়াই হাজার লোক মেরেছে, বাংলাদেশকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলছে ইত্যকার বক্তৃতা দিত। ভেবেছিলাম শ্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে এসব ব্যাপারে হুংকার ছেড়ে বিএনপি ব্যাখ্যা চাইবে। তা না করে তারা মিউ মিউই করেছেন দেখলাম।
বিএনপির আরেকটি বড় অপরিপক্কতা কংগ্রেস-এর বিরোধিতা করা। বিএনপি ঠিক কোন আক্কেলে এই কাজটা করে সেটাও মাথায় আসে না। বিএনপি বর্তমান বিজেপি সরকারকে বোঝাতে চাচ্ছে, কংগ্রেস আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে, তোমরা (বিজেপি) আমাদের পছন্দ করো। শুধু তাই না, বিজেপি সরকারের কাছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন বক্তৃতায় নালিশও করেছে। এসব করে বিএনপি আন্তার্জাতিকভাবে হাসির খোরাক হচ্ছে । দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ না বুঝে রাজনীতি করতে এসে রাজনীতির পরিবেশটাই নষ্ট করে ফেলছে।
ভারতবিরোধিতা করে, মুসলিম জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের নিজেদের দলে টানার রাজনীতি যতই খারাপ হোক, সেটা এতটুকুই সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন ছিল। তার বদলে উলফাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা, অন্যকোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ষড়যন্ত্রমূলক অবস্থান নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর, তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধানসহ অনেকের নাম জড়িত। বিএনপি এসব অভিযোগ কখনো খণ্ডাতে যায়নি। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাবরকে বহিষ্কার করে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও ক’দিন পরই বাবরকে দলে ফিরিয়ে নেয়। এসব ব্যাপার ভারত সরকার জানে। তারা নিশ্চয়ই নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
বিএনপি ভারতবিরোধী রাজনীতি করলেও তাদের ঢের আমেরিকাপ্রীতি আছে। বিএনপি সবচেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে এই জায়গায়, আমেরিকা এই অঞ্চলে ভারতের স্বার্থে সাংঘর্ষিক কোন দ্বন্দ্বে যাচ্ছে না। ফলে আমেরিকার ভক্ত তালিকার গুড বুকে বিএনপি থাকলেও ভারতের কারণে তাদের আন্তর্জাতিক লবিস্টরা কোনো কাজে আসছে না।
এ অবস্থায়ও বিএনপির পরিবর্তন দরকার। বিএনপিকে বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি হবে শুধু রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, সরকারের পতন ঘটানো বা ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া আন্তর্জাতিক শক্তির কাজ নয়। তাদের কাছে আওয়ামী লীগের নামে নালিশ করে লাভ কার্যত কিছুই হয় না। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বড়জোর তাদের অনুকূলে থাকা সরকারের প্রশংসা বা সমালোচনা করতে পারে। তাই তাদের সাথে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং শ্রদ্ধার। কৌশল যা-ই হোক, অসম্মানজনক তিক্ততায় জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
মনোয়ার রুবেল: অনলাইন এক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট, monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৯ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৫
জেএম
** বিএনপি ডুবছে কেন (৩)
** বিএনপি ডুবছে কেন? (২)
** বিএনপি ডুবছে কেন?
মুক্তমত
বিএনপি ডুবছে কেন (৪)
ঘরে শত্রু আ.লীগ, বাইরে ভারত?
মনোয়ার রুবেল, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।