ঢাকা, রবিবার, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০৮ সফর ১৪৪৭

রাজনীতি

এনসিপির ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৫৭, আগস্ট ৩, ২০২৫
এনসিপির ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা রোববার বিকেলের সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার ঘোষণা করেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা করেছে। এসময় বলা হয়, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে সংঘটিত সব মানবতাবিরোধী অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করবে এনসিপি।

একই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করে আজীবন তাদের পাশে দাঁড়াবে দলটি।  

রোববার (৩ আগস্ট) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দলটির সমাবেশে আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম ২৪ দফা সম্বলিত ইশতেহার ঘোষণা করেন।

নাহিদ ইসলাম বলেন, আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতনের ডাক দিয়েছিলাম। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাজিত করে এক অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করেছিলাম। আমাদের সুস্পষ্ট এক দফা দাবি ছিল, আমরা ফ্যাসিবাদী ব্যাবস্থার বিলোপ করে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে চাই। কেবল এক ফ্যাসিবাদী শাসক হটিয়ে আরেক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্থানের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রেখে আমরা নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরতে পারিনি। বরং রাষ্ট্র ও সমাজে দীর্ঘদিনের জেঁকে বসা এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা সমূলে উৎপাটনে আপনাদের তীব্র আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আমরা আপনাদের, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি গঠন করেছি।

তিনি বলেন, গত এক বছরে আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, রাষ্ট্রের মৌলিক ও কাঠামোগত সংস্কারে বিভিন্ন শক্তিশালী পক্ষের বিরোধিতার মুখেও এনসিপি আপনাদের পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের জন্য সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এই মৌলিক সংস্কারগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন ছাড়া ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভেঙে ফেলে আমাদের ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তরিত হবে না।

এনসিপির আহ্বায়ক দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার নিপীড়িত কৃষক ও গণমানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। কিন্তু শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ আরও ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আশায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

‘কিন্তু ১৯৭২ সালের মুজিববাদী সংবিধান ও তৎপরবর্তী বাকশালি অপশাসন, দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ ছিল মানুষের এই সুদীর্ঘ ত্যাগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি নিষ্ঠুর প্রতারণা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি একমুখী ও স্বেচ্ছাচারী মতবাদ। তারপর রাষ্ট্র গঠনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরোলেও স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও এমন একটি রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি যা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। বরং দেশে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থপাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছিল। ’

তিনি বলেন, জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপুল গণবিস্ফোরণ ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এই অপশাসনের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের গণরায়। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই নতুন স্বাধীনতা কেবল সরকার পরিবর্তনের জন্যই ঘটেনি। যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ কয়েম হয়, আমরা সে ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলাম।

নাহিদ ইসলাম বলেন, ফ্যাসিবাদ পতনের বছরপূর্তিতে এই জুলাইয়ে আমরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, জাফলং থেকে সুন্দরবন, বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা; আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা; চায়ের টঙ দোকান থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চা শ্রমিক আপনাদের সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে, আমাদের শহীদ পরিবার আর আহত ভাই-বোনদের প্রত্যাশার কথা শুনেছি। শুনেছি আপনাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নের কথা।

“আমাদের দলের জন্ম, এনসিপির জন্ম, আমাদের সব শ্রম, আপনাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। আপনাদের অভিযোগ-অনুযোগ, প্রত্যাশা আমাদের ভাবনাকে করেছে গভীর, আমাদের লক্ষ্যকে করেছে সমৃদ্ধ। তাই ঠিক একবছর পর আমরা আবার শহীদ মিনারে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, একটি নতুন বাংলাদেশের, আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকের ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করছি। ”

নাহিদ সমাবেশে যে ২৪ দফা ঘোষণা করেন, তা হুবহু উপস্থাপন করা হলো।

১। নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক
উপনিবেশবিরোধী লড়াই, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমরা বহু ভাষা-সংস্কৃতি ও জাতির নতুন বাংলাদেশ তৈরি করবো। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে আমাদের রাষ্ট্রের নতুন যাত্রায়, আমাদের প্রথম অঙ্গীকারই হচ্ছে গণপরিষদের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমাদের এই নতুন সংবিধান, একনায়কতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ করে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনকল্যাণমুখী সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন করবে। আমাদের নতুন রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবন, জীবিকা, মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করবে। এই নতুন সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বিভাজন ও ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। আমরা জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করবো।

২। জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার
এই জনপদের মানুষের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই, এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ই আমাদের প্রেরণা। আমরা জুলাইয়ে সংঘটিত গণহত্যা, শাপলা গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে সংঘটিত সব মানবতাবিরোধী অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করবো। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করে আজীবন তাদের পাশে দাঁড়াবো। জুলাইয়ের জাতীয় ঐক্য ও হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মহিমাকে ধারণ করার জন্য আমরা জুলাইয়ের স্মৃতি রক্ষা করব এবং সবসময় ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের সহযোদ্ধাদের পাশে থাকবো।

৩। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার
আমরা এমন একটি ইনসাফের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পক্ষপাতহীন, নৈর্ব্যক্তিক, মানবিক ও গণমুখী। জনসেবাই হবে তাদের মূলমন্ত্র। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ জবাবদিহিতা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে, যেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন কাজ করে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়ার প্রবণতাকে প্রতিহত করতে পারে। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে জনগণ শুধু নির্বাচনের দিন সব ক্ষমতার উৎস হবে না, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন ও এর গঠন প্রক্রিয়ার মৌলিক পরিবর্তন সাধন করবো, এবং রাষ্ট্র-কর্তৃক নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের আইন করার মাধ্যমে নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব হ্রাস করবো এবং সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ সৃষ্টি করবো।

৪। ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কার
আমাদের রাষ্ট্রে স্বাধীন বিচারবিভাগ ক্ষমতাবানদের পক্ষে অন্ধ অবস্থান নেবে না, বরং মজলুমকে তার প্রাপ্য ন্যায়বিচার বুঝিয়ে দেবে। এছাড়া একটি সত্যিকারের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের সব আইনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের ভিত্তিতে যুগোপযোগী করবো। মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে এমন কোনো আইন তৈরি করা হবে না। আমরা বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয়কে পরিপূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানসহ সম্পূর্ণভাবে ক্রিয়াশীল করবো। মামলার জট ও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে আমরা বিচারক এবং আদালতের সংখ্যা বাড়াবো। আমরা মামলার নথিপত্রগুলোকে ডিজিটাল করা এবং মামলার অগ্রগতি অনলাইনে ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করব। আমরা দেওয়ানী দায় (Civil liability)-এর ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়ে একটি আইনগত কাঠামো প্রণয়ন করব। মানহানির মামলায় শুধু ভুক্তভোগী ব্যক্তিই আইনগত প্রতিকার চাইতে পারবেন এই বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করবো। আমরা গরিবদের জন্য বিনামূল্যে আইনগত সহায়তার ব্যপ্তি বাড়াব। কিশোর সংশোধনী ব্যবস্থার মানবিকীকরণ ও সমাজে পুনর্বাসনের সুব্যবস্থা করব।

৫। সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন
বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণের মাধ্যমে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে; আমরা প্রশাসনে সব প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করব। আমলাতন্ত্রকে সুদক্ষ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন খাতের যোগ্য ও বিশেষজ্ঞদের সরকারে অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও প্রোমোশনের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই হবে একমাত্র মানদণ্ড। সরকারি কর্ম কমিশনের সব প্রশাসনিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে যথাযথ নিয়োগ-কাঠামো তৈরি করব। সরকারি সেবায় কাগজ, সময় এবং সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন কমিয়ে ডিজিটাল গভার্নেন্স চালুর প্রতি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দেব। রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মচ্ছব, বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে আমরা যেকোনো দুর্নীতির দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করবো। সরকারের যেকোনো দাপ্তরিক দুর্নীতি প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ আইনি সুরক্ষা দিতে আমরা হুইসেলব্লোয়ার প্রটেকশন (Whistleblower Protection) আইন প্রণয়ন করবো এবং এই লক্ষ্যে বিদ্যমান সব আইনি কাঠামোর যথাযথ সংস্কার করা হবে। এছাড়া পরিবার ও সমাজে দুর্নীতি-বিরোধী মূল্যবোধ তৈরি ও সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা শিক্ষা কারিকুলামে আমূল পরিবর্তন আনবো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ কর্মসূচি চালু করবো।

৬। জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই যেখানে কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ওয়ারেন্ট ছাড়া তুলে নিয়ে যেতে না পারে। আমরা ঔপনিবেশিক আমলের ১৮৬১ ও ১৮৯৮ সালের পুলিশ আইন যুগোপযোগী করবো। আমরা গড়ে তুলবো এমন এক কাঠামো, যেখানে পুলিশ হবে মানবাধিকারের রক্ষক, নাগরিকের সেবক। আমরা পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধে ও তাদের বদলি-পদায়নে স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করতে একটি স্থায়ী পুলিশ কমিশন গঠন করবো। যেকোনো গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট বা সুস্পষ্ট কারণের উল্লেখ থাকতে হবে এবং গ্রেপ্তারকারী পুলিশের পদবি ও পরিচয় স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। সুস্পষ্ট পেশাগত প্রয়োজন ব্যতীত সব পুলিশকে দায়িত্বরত অবস্থায় ইউনিফর্ম পরতে হবে। আমরা প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যকে বডি ক্যামেরার আওতায় আনবো, যাতে প্রতিটি পদক্ষেপের জবাবদিহি থাকে। আমরা চালু করবো কমিউনিটি-ভিত্তিক পুলিশিং এবং মানবাধিকার-কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ। সহিংস অপরাধের প্রতি আমাদের থাকবে জিরো টলারেন্স। আমরা র‌্যাব বিলুপ্ত করবো এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহার বন্ধ করতে সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো তৈরি করব।

৭। গ্রাম পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকার
মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে, এতে শহরগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে। আমরা গ্রামের স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রেখে শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দিতে চাই। আমরা গ্রামে উৎপাদন ও বিনিয়োগের সুযোগ বাড়িয়ে স্বনির্ভর গ্রাম তৈরি করব। আমরা স্থানীয় পর্যায়ে শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকল্পে গ্রাম পার্লামেন্ট গঠন করবো এবং এই পার্লামেন্টের হাতে স্থানীয় সমস্যা সমাধান, স্থানীয় উন্নয়ন তদারকির দায়িত্ব অর্পণ করবো।

আমরা স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করবো এবং স্থানীয় সরকারকে স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করবো। আমরা সংসদ সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়িত করবো। আমরা স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি, বাজেট প্রণয়ন ও সরকারি ক্রয়ে স্থানীয় জনগণের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। একই সাথে সামাজিক জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকারী কাঠামোগুলো (যেমন, ওয়ার্ড সভা, উন্মুক্ত বাজেট আলোচনা) যেন যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করব। সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পৌঁছে দিতে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবাভিত্তিক কার্যক্রমকে স্থানীয় সরকারের অধীনে ন্যস্ত করবো। আমরা একটি স্বাধীন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করব, যা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তা নিশ্চিত করবে।

৮। স্বাধীন গণমাধ্যম ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ
আমরা সংবাদমাধ্যমের শতভাগ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং যথাযথ আইনি ও নীতি কাঠামোর মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত করবো। আমরা প্রেস কাউন্সিলকে যুগোপযোগী ও কার্যকর করবো। এছাড়া নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কর্পোরেশনের কাছে যাতে বহু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কুক্ষিগত না হয়, রাজনৈতিক দলের স্বার্থের হাতিয়ার না হয়, বরং গণমাধ্যম জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে আমরা তার আইনি কাঠামো তৈরি করব। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা শক্তিশালী করার প্রয়াসে নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ অবারিত করতে নাগরিক সমাজের অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নীতি কাঠামো তৈরি করা হবে। আমরা গণমাধ্যমে মিসইনফরমেশন/ গুজব ও বিভ্রান্তিকর সংবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করবো।

৯। সার্বজনীন স্বাস্থ্য
আমরা এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলবো, যেখানে অর্থের অভাবে কেউ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন না। এমন জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলবো, যাতে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে অ্যাম্বুলেন্সেই জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা শুরু করা যায়। সে উদ্দেশ্য সারা দেশে জিপিএস-চালিত অ্যাম্বুলেন্স ও ডিসপ্যাচ ব্যবস্থা তৈরি করব। আমরা ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড (EHR) সিস্টেম চালু করব, যাতে দেশের সকল স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত থাকবে। ফলে প্রতিটি নাগরিকের একটি ইউনিক হেলথ আইডি থাকবে, যাতে চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল তথ্য ডিজিটালি সংরক্ষিত থাকবে, কখনো হারাবে না। এতে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট ও ভুল চিকিৎসার সম্ভাবনা কমবে। আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করব, যাতে সকল নাগরিক নিজ এলাকাতেই মানসম্মত চিকিৎসা পেতে পারেন। পাশাপাশি একটি কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা চালু করব, যা জাতীয় EHR-এর সঙ্গে সমন্বিত থাকবে, যাতে রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে সহজে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন। সেবায় বৈষম্য দূর করতে অঞ্চলভিত্তিক হৃদরোগ, ট্রমা ও অন্যান্য বিশেষায়িত কেন্দ্র স্থাপন করবো। মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে আমরা এ খাতে পৃথক বাজেট, প্রশিক্ষিত জনবল এবং সেবার প্রসার ঘটাব। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ন্যায্য বেতন, ক্যারিয়ারে অগ্রগতির সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি, নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে ডে-কেয়ার সেন্টারসহ নারীবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করব। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার অবসান ঘটাতে কার্যকর নীতি গ্রহণ করব। আমাদের জনপদের মানুষের জন্য নতুন ও কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কার করতে আমরা বিশ্বমানের একটি জাতীয় বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠা করব।

১০। জাতিগঠনে শিক্ষানীতি
আমরা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ভবিষ্যতের উদ্ভাবন, শিল্পায়ন ও অর্থনীতির জন্য প্রস্তুত একটি দক্ষ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলব। শিক্ষা পণ্য নয়, অধিকার। বিজ্ঞান, গণিত, প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষায় শক্ত ভিত তৈরিতে আমাদের থাকবে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা। আমাদের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুনাগরিক তৈরি করবে। শিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে মানসম্পন্ন গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি। আমরা সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে আলোচনাক্রমে বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা, ও ইংরেজি মাধ্যমসহ বিদ্যমান সকল ধরনের শিক্ষার মাধ্যম ও পদ্ধতিগুলোর একটি যৌক্তিক সমন্বয় করব এবং আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে জাতীয় পাঠ্যক্রমকে আধুনিকায়ন করব। কর্মমুখী, বৃত্তিমূলক, নার্সিং শিক্ষা এবং দক্ষতা প্রশিক্ষণকে আন্তর্জাতিক মানের, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলবো, যাতে সকল নাগরিকের জন্য টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ চাহিদা-সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রশিক্ষিত শিক্ষক, অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রযোজনীয় সমন্বয় করব। আমরা শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে বহির্বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে পৃথক বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্রীয় নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রাজনীতি ও তার ওপর জাতীয় রাজনীতির প্রভাবের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।

১১। গবেষণা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব
আমরা উন্নত বিশ্ব থেকে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও দেশে প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবো। আমরা বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি গবেষণায় সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা ও যৌথ উদ্যোগে ৫০ বছর মেয়াদি বিভিন্ন বিজ্ঞান গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করবো। এসব প্রকল্পের আওতায় অ্যারোনেটিক্স, মহাকাশ গবেষণা, সিগনাল ইন্টেলিজেন্স, রাডার প্রযুক্তি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সেমিকন্ডাকটার, কোয়ান্টাম টেকনোলজি, ন্যানো-টেকনোলোজি, নিউক্লিয়ার সায়েন্স ও বায়োটেকনোলোজি প্রভৃতি বিষয়ে সর্বাধুনিক গবেষণা ল্যাব স্থাপন করবো। পাশাপাশি এ বিষয়ক বিশ্বের সেরা ল্যাবগুলোর সাথে সহযোগিতা স্থাপন এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রতিযোগিতামূলক বেতনে নিয়োগ করবো। কম্পিউটেশনাল গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার জন্য একটি ন্যাশনাল কম্পিউটিং সার্ভার ও বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক কম্পিউটিং ক্লাস্টার তৈরি করবো। বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর আউটপুট মূল্যায়নের জন্য কমিশন গঠন করব এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সব প্রকার অপ্রযোজনীয় আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করবো। তথ্য ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমিশন গঠন করবো।

১২। ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিসত্তার মর্যাদা
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের ধর্মীয় পরিচয় ও আচরণকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্যাতনের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা সকল ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে একটি বহুভাষা, বহু-সংস্কৃতি, বহু-জাতিভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ব। আমরা ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যের শ্রদ্ধাশীল। ইসলাম-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, এবং জাতি-পরিচয়ের কারণে যেকোনো প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ, নির্যাতন ও নিপীড়নকে আমরা শক্তহাতে প্রতিহত করবো। এসব ঘটনা মোকাবিলায় আমরা স্বাধীন তদন্তের এখতিয়ার-সম্পন্ন মানবাধিকার কমিশনের একটি বিশেষ সেল গঠন করবো। আমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বেদখলকৃত জমি উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। দলিত-হরিজন-তফসিলি সম্প্রদায়সহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের বিকাশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,  কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তায় আমরা বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করবো। আমরা সকল জাতিসত্তার ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোকে কার্যকর করবো এবং বিদ্যালয়ে নিজ-নিজ মাতৃভাষা শিক্ষার সুযোগ অবারিত করবো। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতির বিকাশ ও জাতীয় উৎসবগুলোকে সকল সাংস্কৃতির মেলবন্ধনে পরিণত করতে আমাদের থাকবে সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা। আমরা স্ব-স্ব জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অখণ্ডতা রক্ষা করবো।

১৩। নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের পরও রাষ্ট্র জাতীয় জীবনে ব্যাপক হারে নারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে নিম্নকক্ষে ১০০টি সংরক্ষিত আসনে নারী প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো যার সংখ্যা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সাথে সাথে হ্রাস করা হবে। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের প্রাপ্য অধিকার দ্রুত বুঝে পেতে সর্বপ্রকার আইনি সহায়তা প্রদান করার ব্যবস্থা নেব। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বেতন কাঠামোতে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পরিবারে ও আমাদের সার্বিক অর্থনীতিতে গৃহিণী নারীদের অবদান দেশজ উৎপাদন হিসেবে মর্যাদা পাবে ও মোট দেশজ উৎপাদনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রতিটি থানায় নারী সহিংসতা প্রতিরোধ সেল ও নারী পুলিশ নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হবে। ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়া ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে ফাস্ট স্ট্র্যাক ট্রাইব্যুনাল চালু করা হবে এবং ভিকটিমদের ব্যক্তি পরিচয় গোপন রাখার জন্য গণমাধ্যম নীতিমালা জারি করা হবে। কর্মক্ষেত্রে ব্রেস্ট-ফিডিং ও স্যানিটারি উপকরণ ব্যবহারের নির্দিষ্ট স্থান রাখার নিয়ম করা হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, অনলাইন ও যানবাহনে নারীদের হয়রানি ও নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি কাঠামোর যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির বিধান করা হবে। নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে উন্নতমানের চাইল্ড কেয়ার ও বয়স্ক সেবা সার্ভিস গড়ে তোলায় প্রণোদনা দেওয়া হবে এবং স্বল্প আয়ের পরিবারকে চাইল্ড কেয়ার ভর্তুকি প্রদান করা হবে। আমরা কর্মজীবীদের পূর্ণ বেতনে অন্তত ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ও এক মাস পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করব। নারীদের মাতৃত্বকালীন প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আমরা যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবো। নারীদের কর্মস্থলে নিরাপদ যাতায়াতের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হবে। সব নারীর জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসামগ্রীর প্রাপ্যতা সুলভে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। অনুন্নত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চল, মাদ্রাসা ও পাহাড়ি অঞ্চলের স্বল্প আয়ের পরিবারের নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি চালু করব। বাল্যবিবাহ ও যৌতুক বন্ধের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সম্পৃক্ত করব।

১৪। মানবকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি
অর্থনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে মানুষের সামগ্রিক বিকাশ। কেবল দক্ষতা নয়, মানুষের উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গঠনে বিনিয়োগ করতে হবে। আমরা বাজার-ভিত্তিক কিন্তু কল্যাণমুখী অর্থনৈতিক দর্শন মেনে একটি আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবো, যেখানে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বরদাশত করা হবে না, অলিগার্ক শ্রেণীর প্রভাব ধ্বংস হবে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার বিকাশ নিশ্চিত হবে। আমরা উন্নয়নকে শুধু জিডিপির সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করবো না। নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, ইন্টারনেট এসব মৌলিক সেবা ও সেবার মান এবং প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের সুরক্ষাই হবে আমাদের উন্নয়নের মানদণ্ড।

আমরা বেকার ভাতা, বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিক ভাতা, শিশু ভাতা প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষা সেবাকে নাগরিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবো। পথশিশু ও ছিন্নমূল মানুষদের জন্য আমরা পুনর্বাসন, শিক্ষা, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিদ্যমান কাঠামোকে শক্তিশালী করবো, বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেব, ঋণ খেলাপি রোধে একক ক্রেডিট আইডি সহ ন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম চালু করব, পুঁজিবাজার সংস্কার ও সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুনর্গঠন করব এবং এই খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করব।

১৫। তারুণ্য ও কর্মসংস্থান
আজ বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ বেকার, এদের প্রতি তিনজনের দুইজনই তরুণ। সব কর্মক্ষম নাগরিকের জন্য দেশে ও বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমরা রপ্তানিমুখী শ্রমঘন-শিল্পের বহুমুখীকরণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলব। কর্মক্ষেত্রে প্রায়োগিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষাজীবনে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতনভুক্ত ইন্টার্নশিপের সুযোগ সম্প্রসারণ করবো। প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নফাঁস, দুর্নীতি, সুপারিশ ও স্বজনপ্রীতি সম্পূর্ণ দূর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবো এবং গ্রেড ভিত্তিক সমন্বিত পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করবো। । আমরা তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা-সহায়ক পরিবেশ তৈরি করব। আমরা জেলা-ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং ও রিমোট ওয়ার্ক হাব গড়ে তুলবো এবং পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, কো-ওয়ার্কিং স্পেস, ও উচ্চগতির ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করবো। বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদ রপ্তানির লক্ষ্যে আইটি, স্বাস্থ্যসেবা, নার্সিং, ব্যবস্থাপনা, লজিস্টিক্স, হসপিটালিটি ও প্রকৌশল খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেব। এজন্য আমরা ওই সেক্টর ও দেশভিত্তিক সুনির্দিষ্ট দক্ষতা ও ভাষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলবো। আমরা বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে বিভিন্ন কারিগরি পেশায় প্রশিক্ষণ ও সনদ প্রদানের আওতা বাড়াবো এবং সেগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ করতে বিদেশি প্রত্যয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করবো। তরুণদের মাদক ও অপরাধপ্রবণতা রোধে প্রতি জেলায় আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরি করব।

১৬। বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নীতি
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে রপ্তানির বহুমুখীকরণ এবং বিকল্প বাজারে প্রবেশাধিকারে বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে আমরা বিভিন্ন দেশ ও ব্লকের সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করবো। আমরা গার্মেন্টসের বাইরে উচ্চ সম্ভাবনাময়, শ্রমঘন খাতগুলোতে বিনিয়োগ ও প্রণোদনা জোরদার করবো, যেমন চামড়া ও পাদুকা শিল্প, আসবাব ও হোম ডেকর, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য প্রভৃতি। পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন উচ্চমূল্য সংযোজন খাত যেমন, ঔষধশিল্প, ইলেকট্রনিক্স, এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) প্রসারে বিশেষ নীতি সহায়তা প্রদান করবো। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে দেশের ঔষধ শিল্পে সৃষ্ট সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেব। ব্যবসা সহজীকরণ, জ্বালানি নিরাপত্তা ও আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে বৈদেশিক বিনিযোগের এক আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করবো। আমরা ৫০ বছর মেয়াদী শিল্প উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে শিল্পখাতের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করবো। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য আমরা আমাদের তুলনামূলক সুবিধার (কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজ) শ্রমঘন খাতগুলোতে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করবো। আমরা চট্টগ্রাম, মোংলা, মাতারবাড়ী বন্দরকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও আশেপাশের অঞ্চলের একটি লজিস্টিক হাব হিসেবে গড়ে তুলবো। ইকো ট্যুরিজম তথা পর্যটন শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেব।

১৭। টেকসই কৃষি ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব
আমাদের নতুন বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের সরবরাহ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে, পাশাপাশি ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণ হবে। আমরা কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, জলবায়ু-সহনশীল জাতের বীজ, পরিবেশবান্ধব সার এবং প্রযুক্তিনির্ভর সহায়তার উপর যথাযথ ভর্তুকি প্রদান করবো-যার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও লাভজনকতা বাড়ানো হবে। কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে দক্ষ ও আধুনিক করে গড়ে তোলা হবে, প্রশিক্ষণ ও মোবাইলভিত্তিক পরামর্শসেবা সহজলভ্য করা হবে। ফসল, মাছ ও প্রাণিসম্পদ খাতে অঞ্চলভিত্তিক অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করে উপকূলীয় লবণাক্ততা ও খরা প্রবণ এলাকার জন্য টেকসই সমাধান নিশ্চিত করা হবে। আমরা কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি বুঝতে একটি ডাইনামিক জাতীয় ডেটাবেস তৈরি করা হবে। খাদ্যদ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে আমরা টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যবিক্রি, বাজার বাফারিং অপারেশন এবং প্রযোজনীয় আমদানিকে কৃষি উৎপাদন পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় করে পরিচালনা করবো। কৃষি উপকরণে ভেজাল রোধে কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহিমূলক লাইসেন্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। বিষমুক্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ উৎসাহিত করে কৃষিকে রপ্তানিমুখী ও টেকসই খাতে রূপান্তর করা হবে। একইসঙ্গে, দেশীয় বীজ গবেষণা, সংরক্ষণ ও বিতরণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করে শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করাই হবে আমাদের অঙ্গীকার।

১৮। শ্রমিক-কৃষকের অধিকার
আমরা বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহ, অভিবাসী, পরিবহন ও স্বনিয়োজিত সকল শ্রমিকের স্বীকৃতি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করবো। আমরা দিনমজুর, চা শ্রমিক, গৃহকর্মী, নির্মাণকর্মী, পরিবহন কর্মীসহ সকল নিম্নআয়ের শ্রমিকের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অঞ্চল-ভিত্তিক আয়-সক্ষমতা ও ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে একটি সমন্বিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো তৈরি করবো। আমরা শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, আইনি সুরক্ষা ও পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব থেকে রক্ষা এবং শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার সামগ্রিক সুরক্ষার জন্য ‘স্থায়ী শ্রম কমিশন’ গঠন করবো। আমরা শ্রম আইনকে যুগোপযোগী এবং শ্রম ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ও সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করবো। আমরা শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক কর্ম-সুরক্ষা-বীমা ও ন্যূনতম পেনশন তহবিল গঠনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করবো। শ্রমিক, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আমরা বিদ্যমান সরকারি সঞ্চয় স্কিমে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করবো। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের জন্য আমাদের থাকবে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা। জোরপূর্বক শিশুশ্রম বন্ধে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

আমাদের লক্ষ্য প্রতিটি কৃষকের জন্য মর্যাদাপূর্ণ, নিরাপদ ও লাভজনক জীবিকা নিশ্চিত করা। কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হিমাগার, সরাসরি বিক্রয়কেন্দ্র ও পরিবহন সেবা সম্প্রসারণ করে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানো হবে। আমরা "Area-Yield-Index" ভিত্তিক কৃষি বীমা চালু করে কৃষকদের উৎপাদন ঝুঁকি হ্রাস করবো। আমরা স্মার্ট কৃষির সুবিধা পৌঁছে দিতে কৃষকদের জন্য আবহাওয়া, বাজারদর ও সরকারি সহায়তা সম্পর্কিত তথ্য প্রদানকারী একটি সমন্বিত জাতীয় মোবাইল প্ল্যাটফর্ম চালু করব।

১৯। জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা
আমরা জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জনগণের সার্বভৌম মালিকানা প্রতিষ্ঠা করবো। প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে আমরা দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করবো। আমাদের নীতিমালায় প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হবে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদার সমন্বয় করে। এছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদে স্থানীয় জনগণের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা হবে। আমরা বেপরোয়া ও অবৈধভাবে কয়লা, গ্যাস, পাথর ও খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান ও নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করবো এবং সব প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনে জাতীয় স্বার্থের সুরস্কার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক চুক্তি পুনর্বিন্যাস করব। সমুদ্রসীমা ও এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে মৎস্য ও খনিজ সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার প্রসার ঘটাবো। সুন্দরবনসহ দেশের জীববৈচিত্র্য ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে প্রাকৃতিক সম্পদের অংশ হিসেবে সুরক্ষিত রেখে ক্ষতিকর শিল্পায়ন রোধ করব।

২০। নগরায়ন, পরিবহন ও আবাসন পরিকল্পনা
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আমাদের শহরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আমরা রাজধানীসহ শহরগুলোতে নদী ও খালকেন্দ্রিক নগর ব্যবস্থাপনা এবং সমন্বিত উচ্চগতির গণপরিবহনমুখী ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলব। বায়ু দূষণ মোকাবিলা, সুপেয় পানির সুব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, খাল ও দখলকৃত জমি উদ্ধার, গ্রিন বেল্ট, জনপরিসর তৈরি করবো। পাশাপাশি নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত সামাজিক আবাসন ও এলাকাভিত্তিক বাড়ি ভাড়া নীতি কাঠামো তৈরির মাধ্যমে শহরগুলোকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বসবাসযোগ্য করে তোলা হবে। শহরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র ও ভাসমান জনগোষ্ঠী, যারা এখনো পর্যন্ত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে রয়ে গছেন, তাদের অন্তর্ভুক্ত করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে। শুধু আধুনিকায়ন নয়, আমাদের নগর পরিকল্পনায় আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাণ-প্রকৃতি এবং আমাদের সভ্যতাগত পরিচয় অক্ষুণ্ণ থাকবে। অন্যান্য শহরে নাগরিক সেবা, সরকারি পরিসেবা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা রাজধানী ঢাকার কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করবো। এছাড়া শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানে আমরা নগর সরকারের ধারণা বাস্তবায়ন করবো। আমরা আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর ও সাশ্রয়ী করতে দেশের সব জেলাকে দ্রুতগতির ট্রেন ও এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসবো এবং সিভিল এভিয়েশনের পরিধি বাড়াবো। আঞ্চলিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। আমরা গ্রাম ও শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ ও সবুজ স্থান সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করবো।

২১। জলবায়ু সহনশীলতা ও নদী-সমুদ্র রক্ষা
আমরা একটি জলবায়ু-সহনশীল, দূষণমুক্ত ও পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়ব যেখানে নদী, বায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সবুজ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। বড়বড় শহর ও তার আশেপাশের এলাকাকে আমরা "No Brick-Kiln Zone" ঘোষণা করবো। এছাড়া আমরা সামাজিক বনায়নে বিশেষ গুরুত্বারোপ করবো। আমরা অপরিকল্পিত বালু-পাথর-খনিজ উত্তোলন ও বনজ সম্পদ ধ্বংস বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করব। উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু দুর্যোগ, দুর্যোগ, লবণাক্ততা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য আমরা নিরাপদ বাসস্থান ও অবকাঠামো নির্মাণ করব। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়িয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণের টেকসই ভিত্তি গড়ে তুলব। আমরা সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, নদী ভাঙন ও বন্যা মোকাবিলায় টেকসই অবকাঠামো গড়ে তুলবো। আমরা আবহাওয়া ও দূর্যোগ পূর্বাভাস ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করব ও জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ফ্রেমওয়ার্ক বানাবো। বঙ্গোপসাগরে আমাদের সমুদ্রসীমা ঘিরে একটি সুনীল অর্থনীতি গড়ে তুলবো ও বঙ্গোপসাগরের রাজনৈতিক হিস্যা দেশের জনগণের অভিপ্রায়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করবো। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে কূটনৈতিক চাপ তৈরি করবো।

২২। প্রবাসী বাংলাদেশির মর্যাদা ও অধিকার
আমরা মনে করি প্রবাসী বাংলাদেশিরা কেবল রেমিট্যান্সের উৎস নন, তারা রাষ্ট্রের সম্মান, সংগ্রাম ও পুনর্গঠনের অন্যতম অংশীদার এবং বিদেশে বাংলাদেশের দূত। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে দেড় কোটির বেশি প্রবাসী অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, আমরা সেই অবদানকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করবো। আমরা প্রবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতে কাজ করবো। কোনো প্রবাসী শ্রমিক মারা গেলে তার মরদেহ হয়রানিমুক্তভাবে দেশে আনার ব্যবস্থা নেব এবং তার পরিবারকে সর্বপ্রকার সহায়তা প্রদান করবো। প্রবাসীদের জন্য ভোটাধিকার, দূতাবাস ও বিমানবন্দরগুলোতে হয়রানি-মুক্ত সেবা, জরুরি সহায়তা তহবিল, দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ ও ডিজিটাল সরকারি সেবা নিশ্চিত করব। দেশে ফিরে আসা কিংবা সংকটে পড়া প্রবাসীদের জন্য থাকবে পুনর্বাসন ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত। আমরা মানবপাচার রোধ এবং বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের স্বার্থ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। আমরা একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রবাসীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করব।

২৩। বাংলাদেশপন্থী পররাষ্ট্রনীতি
আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশের স্বার্থে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবসময় দলীয় স্বার্থ ও সংকীর্ণতার উর্ধ্বে থাকবে। এনসিপি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রক্ষার প্রশ্নে আপসহীন থাকবে। আমরা পারস্পরিক সম্মান ও সম-মর্যাদার ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলবো এবং আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেকোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করব। সীমান্ত হত্যা বন্ধে ও আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে পেতে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বোচ্চ পর্যায়ে দৃঢ় ভূমিকা নেওয়া হবে। আমরা দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক কূটনীতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক সমাধান করব। আমরা মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলবো। শান্তি, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা, ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সার্ক, আসিয়ান, ওআইসি, ন্যাম, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সক্রিয় অংশীদারত্ব গড়ে তোলা হবে। শুধু মাত্র স্টেট এক্টর নয়, প্রতিটা দেশের আন্তঃযোগাযোগ ও তাদের ইনসাফ নিশ্চিতকরণে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসিকে গুরুত্ব দেব। দক্ষিণ এশিয়া, গ্লোবাল সাউথসহ বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতি বাংলাদেশের থাকবে অকুণ্ঠ সমর্থন, সহযোগিতা ও সংহতি।

২৪। জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল
আমরা বিশ্বাস করি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ছাড়া কার্যকরী বৈদেশিক নীতি সম্ভব নয়। গণপ্রতিরক্ষা দর্শনের ভিত্তিতে আমরা তরুণ জনগোষ্ঠীকে একটি সংগঠিত সুশৃঙ্খল শক্তি হিসেবে দেশের সর্বাত্মক সেবায় উদ্বুদ্ধ করবো। আমরা অত্যাধুনিক সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেমের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবো। পাশাপাশি, সর্বাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি অধিগ্রহণ, দেশীয় সামরিক গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে একটি UAV (Unmanned Aerial Vehicle) ব্রিগেড গঠন করবো। একই সঙ্গে, আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সংহত করতে নন-নিউক্লিয়ার সেকেন্ড স্ট্রাইক সক্ষমতা অর্জন করবো এবং আমাদের নৌবাহিনীকে সাবমেরিন-ভিত্তিক একটি শক্তিশালী ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী হিসেবে গড়ে তুলবো। আমাদের প্রতিরক্ষা কৌশলের কেন্দ্রে থাকবে নিজস্ব ভূ-প্রাকৃতিক গঠন, যা নদী-বিধৌত অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগর-কেন্দ্রিক নিরাপত্তা চাহিদা মাথায় রেখে সুসমন্বিতভাবে গড়ে তোলা হবে। রাষ্ট্রীয় সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে, আমরা একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করবো। আমাদের সমন্বিত প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্রে থাকবে সংসদীয় নজরদারি, নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি।

বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে নাহিদ বলেন, আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই শহীদ মিনারেই আমরা শপথ নিয়েছিলাম এই দেশকে স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত করব। আপনারা সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়ায় আমরা সবাই মিলে ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাজিত করেছি এবং দেশের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে নিয়েছি। আজ আবারও এই শহীদ মিনার থেকে আমরা আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি: আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনে এই ঐতিহাসিক ২৪ দফাকে বাস্তবে রূপান্তর করে সব নাগরিকের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ি।

টিএ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।