জুলাই ঘোষণাপত্রে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। বুধবার (৬ আগস্ট) বিকেলে পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন।
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম জুলাই ঘোষণাপত্রে ১৯৭১, ১৯৭৫’র সাত নভেম্বর ও ৯০’র আন্দোলনসহ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় ৪৭ এবং পতিত ফ্যাসিস্ট আমলের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড শাপলা হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও আলেম-উলামাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ না করে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন মনে করে, এতে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গতকাল ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। জুলাই ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং প্রধান উপদেষ্টার গতকালের ভাষণ আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণের পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জুলাই ঘোষণাপত্র এবং প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ গভীর পর্যবেক্ষণ করেছে। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আমাদের প্রথম পর্যবেক্ষণ হলো- ঘোষণার আগে এটা আমরা দেখিনি। জাতির এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল উপস্থাপনার আগে থেকে না জেনে উপস্থিত থেকে তাতে সমর্থন জানাতে হয়েছে এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর ছিল।
রেজাউল করীম বলেন, ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন ধারায় হাসিনা ও আওয়ামী অপকর্মের উল্লেখ আছে। ১৭তম ধারায় জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের উল্লেখ আছে। কিন্তু কোথায়ও ফ্যাসিবাদের দোসর রাজনৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির উল্লেখ নাই। ইসলামী আন্দোলন মনে করে এটা ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের পথ খুলে দেবে।
তিনি আরও বলেন, ঘোষণাপত্রের ধারা ১৯ এ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগের রাজনৈতিক ও আইনি বৈধতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উল্লেখ করা হলেও ধারা ২৫ এ জনতা ও তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন, মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারকে পরবর্তী জাতীয় সংসদের ওপরে ন্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে এর মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। একই সাথে ধারা ২৭ এ জুলাই অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতিকে ‘উপযুক্ত’ শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আপেক্ষিক করে পরবর্তী সরকারের ওপরে ন্যস্ত করে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
মুফতি রেজাউল করীম আরও বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। তার ভাষণ সুলিখিত এবং তার পাঠ আবেগ মিশ্রিত। ভাষণে সরকারের নানা সাফল্যের কথা এসেছে এবং আগামী ফেব্রুয়ারি-২৬ এ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা এসেছে। এখানে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, জুলাই সনদ এখনো না হওয়া আমাদেরকে সংস্কার নিয়ে অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক যাত্রাও শুরু হয়েছে। তিনিও বারবার বলছেন, ফেব্রুয়ারি দূরে নয়। কিন্তু সংস্কারের প্রতিশ্রুতি সম্বলিত জুলাই সনদ এখনো হয়নি। সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। জনতার প্রত্যাশা অনুসারে সংস্কারকে স্থায়ী করার ব্যবস্থা না নিয়ে এখন তো সংস্কারকে পরবর্তী সরকারের ওপরে ন্যস্ত রেখে পুরো সংস্কার কার্যক্রমকে অনিশ্চিত করে রাখা হয়েছে। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, অধ্যাদেশ জারি বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনিভিত্তি তৈরি করতে হবে এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতেই জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের আমীর বলেন, আমরা সুদীর্ঘকাল থেকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছি। অভ্যুত্থানের পরে পিআরের পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠন হয়েছে এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমরা বারবার উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আয়োজনের জন্য সংস্কার কমিশনে কথা বলেছি, লিখিত জানিয়েছি। এর যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিৎ ছিল পিআর নিয়ে সংস্কার কমিশনে এজেন্ডা রাখা। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনে আমাদের বারবার প্রচেষ্টা সত্যেও নিম্নকক্ষে পিআর নিয়ে কোনো এজেন্ডাই রাখা হয় নাই। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক সংস্কার সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পিআর নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই নির্বাচনের মাস নির্ধারণ করা জনদাবীর প্রতি স্পষ্টত উপেক্ষা করা। আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান জানাবো, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এই জনদাবীর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কার্যক্রম শুরু করবেন না। একই সাথে ঐকমত্য কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাবো, অতিদ্রুত পিআর নিয়ে এজেন্ডা নির্ধারণ করে আলোচনা শুরু করুন। সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু উচ্চকক্ষের ভোট গ্রহণ কীভাবে হবে এবং উচ্চকক্ষের ক্ষমতা, কার্যপরিধি ও মর্যাদা কি হবে তা নিয়ে বিস্তারিত কোনো সিদ্ধান্ত হয় নাই। নির্বাচনের আগে এইসব বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা স্মরণীয় নির্বাচন আয়োজন করতে চাইছেন। তার ইচ্ছাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা, সক্রিয়তা নিয়ে দেশের কেউই আশ্বস্ত হতে পারছে না। আগামী ফেব্রুয়ারির আগে এর সমাধান হবে তেমন আশা করার যৌক্তিক কারণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, দেশের আইন-শৃঙ্খলা উন্নতি না হলে আগামী নির্বাচনও কলঙ্কিত হতে পারে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য কঠিন হবে। তাই বলবো, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য জনপ্রশাসন থেকে ফ্যাসিস্টের অবশিষ্টাংশের ব্যাপারে দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিন। দল নিরপেক্ষ পেশাদার জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে কার্যক্রম জোরালো করুন।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ফ্যাসিস্টের বিচারের প্রসঙ্গ এসেছে। তবে এর মাত্রা, ব্যাপকতা ও গতি নিয়ে আমাদের অসন্তোষ আছে। সেটা জানিয়ে বিচার কার্যক্রমের পরিধি আরও বিস্তৃত করে এর গতি বৃদ্ধি করার আহবান জানাচ্ছি। তিনি অনেক সাফল্যের কথা বলেছেন। তবে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে। পাচারকৃত টাকা উদ্ধার এখনো দৃশ্যমান হয় নাই। কর্মসংস্থানে আশাজাগানিয়া কিছু এখনো দেখা যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনতার কষ্ট এখনো বিদ্যমান। এসব বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়ার আহ্বান করবো। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইতিবাচক রাজনীতি করে। আমরা সবসময় সম্ভাবনাকে বড় করে দেখি। আমরা নির্বাচনমুখি দল। নির্বাচনের জন্য আমাদের প্রস্তুতিও চলমান। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের উদ্বেগ, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশাকে আমলে নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। জুলাই সনদ দ্রুত আলোর মুখ দেখবে। পিআর নিয়ে একটি যৌক্তিক সমাধান হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে প্রত্যাশা মাফিক আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জুলাই অভ্যুত্থান সার্থকতা পাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
টিএ/এমজে