ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

সভাপতি-সম্পাদক নিয়ে অসন্তুষ্ট খাগড়াছড়ি ছাত্রলীগ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
সভাপতি-সম্পাদক নিয়ে অসন্তুষ্ট খাগড়াছড়ি ছাত্রলীগ টিকো চাকমা ও জহির উদ্দিন ফিরোজ। ছবি: বাংলানিউজ

খাগড়াছড়ি: কমিটি গঠনের দীর্ঘ চার বছরেও সংগঠনের বর্ধিত সভা করতে না পারা, নতুন ইউনিটের সম্মেলন দিতে না পারা, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, অযোগ্য লোকদের পদ দেওয়া, দলে বিভক্তি, কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য, শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়াসহ বিস্তর অভিযোগ জমেছে খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি টিকো চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন ফিরোজের বিরুদ্ধে।

ইতোমধ্যে এসংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের কাছে জমা দিয়েছেন জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, গত চার বছরে ছাত্রলীগকে বিভক্ত করে ব্যক্তিস্বার্থে নানাভাবে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছেন সভাপতি-সম্পাদক।

নেতাকর্মীকে বহিষ্কার কিংবা পুনর্বহাল দুটোই সভাপতি-সম্পাদকের ইচ্ছায় চলে। এনিয়ে অভিযোগ হলেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে বিষয়টি জানতে কেন্দ্রীয় নেতারা খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।  তবে, এসব অভিযোগ ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন সভাপতি টিকো চাকমা ও সম্পাদক জহির উদ্দিন ফিরোজ।
 
জানা যায়, ২০১৫ সালের ১ জুন খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের ১৪ দিন পর কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এই কমিটি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ছিল। কারণ, খাগড়াছড়ি ছাত্রলীগের ইতিহাসে এটিই ছিল নেতাকর্মীদের ভোটে নির্বাচিত প্রথম কমিটি। তবে, কিছুদিনের মধ্যেই সেই উৎসাহে ভাটা পড়ে। কমিটি গঠনের পর থেকে সভাপতি-সম্পাদক কোনো বর্ধিত সভা করতে পারেননি। প্রত্যেকটা উপজেলা কমিটির বয়স পাঁচ থেকে সাত বছর পেরিয়ে গেলেও দিতে পারেনি কোনো সম্মেলন। অভিযোগ রয়েছে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ের কোনো কমিটিতে পদে না থাকার পরেও অনেককে জেলা ছাত্রলীগে পদ দেওয়া হয়েছে। এতে অসন্তুষ্ট নেতাকর্মীরা।
 
মানিকছড়ি উপজেলা কমিটির সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এখনকার চেয়ে ছাত্রলীগের আগের কমিটি অনেক শক্তিশালী ছিল। নতুন জেলা ছাত্রলীগ কমিটি গঠনের পর পদ-পদবি থাকলেও সম্মিলিত সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। নেই নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগও। একসঙ্গে বসে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করা, নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার মতো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তারপরও আমরা উপজেলা ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
 
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের কাছে প্রতিকার না পেয়ে দুই দফায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে পানছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। এতে শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া, কারণ ছাড়া শৃঙ্খলাভঙ্গকারীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারসহ বেশ কিছু অভিযোগ করা হয়।
 
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, পানছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাথ দেবের ওপর হামলার ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন জড়িত ছিলেন। এ ঘটনায় মামলা চলমান। একই সঙ্গে তোফাজ্জল হোসেন একটি ধর্ষণ মামলারও আসামি। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শামীম ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক হন। তাদের বিরুদ্ধে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদককে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও তারা তা করেননি। উল্টো কোনো কারণ ছাড়া ২০১৫ সালে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মশিউর রহমানের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে পুনর্বহাল করা হয়।
 
পানছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শ্রীকান্ত দেব মানিক বাংলানিউজকে বলেন, সভাপতি-সম্পাদকের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের সাংগঠনিক সহযোগিতা পাইনি। উল্টো শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলায় কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। যদিও, পরে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনদাতা মশিউর রহমানের কোনো কারণ ছাড়া বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সভাপতি সম্পাদক কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই খেয়াল-খুশি মতো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন।
 
মহালছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক সাংগঠনিক অবস্থা জানতে কোনো দিন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। বিভক্ত ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের কর্মকাণ্ড থেকে আমরা দূরে ছিলাম। তাই আমাদের মধ্যে কোনো গ্রুপিং হয়নি।
 
এদিকে, প্রত্যেকটা উপজেলা কমিটির মেয়াদ পাঁচ থেকে সাত বছর পেরিয়ে গেছে। পদধারী নেতারা অধিকাংশই বিবাহিত। অনেকের নেই ছাত্রত্বও। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে তারা কমিটিগুলোর পদে রয়েছেন। এমনকি খোদ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকও বিবাহিতা বলে খবর ছড়িয়েছে।
 
খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নুরুল আলম রনি বাংলানিউজকে বলেন, অযোগ্য নেতৃত্ব, দলে গ্রুপিং ও ভিন্ন মতাদর্শীদের নেতা বানানোর কারণে সংগঠন দুর্বল হয়ে গেছে। জেলা ছাত্রলীগ গঠনের ছয় মাস পর পৌর নির্বাচনে সভাপতি-সম্পাদক বিভক্ত অবস্থান নেওয়ায় তা তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দলের বিভিন্ন পদে আঞ্চলিক সংগঠনের লোকদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
 
২০১৫ সালে খাগড়াছড়ি পৌর নির্বাচনে সভাপতি টিকো চাকমা ও জহির উদ্দিন ফিরোজ বিপরীতমুখী অবস্থান নেন। টিকো চাকমা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. শানে আলমের পক্ষে থাকলেও জহির উদ্দিন ফিরোজ স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমানের  আলোচিত-সমালোচিত পৌর মেয়র মো. রফিকুল আলমের পক্ষে অবস্থান নেন। গ্রুপিংয়ের শুরু সেখান থেকে। সবশেষ সংসদ নির্বাচনেও জহির উদ্দিন ফিরোজ দলের মনোনীত প্রার্থী খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন। মূলত, পৌর নির্বাচনের পর থেকে আলোচিত আলম পরিবারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আলাদাভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নেন ফিরোজ, যার ছবি এখনো তার ফেসবুক আইডিতে দেখা যায়।

এদিকে, খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন ফিরোজ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি পৌর নির্বাচনে মাটিরাঙ্গায় নৌকার প্রার্থী মো. শামছুল হকের পক্ষে কাজ করেছি। আর সংসদ নির্বাচনের আগে আমিসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ছিল। আমরা চেয়েছি নির্বাচনের আগে যেন মামলাগুলোর সমাধান হয়। তারপরও আমরা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পুরোদমে মাঠে ছিলাম।  
তবে, গ্রুপিংয়ের কারণে সাংগঠনিক তৎপরতায় ঘাটতি ও শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।
 
খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি টিকো চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, জেলা ছাত্রলীগের দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মাথায় পৌর নির্বাচন নিয়ে সংগঠনে বিরোধ দেখা দেয়। সেসময় আমি নৌকা প্রতীকের পক্ষে থাকলেও সাধারণ সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী রফিকুল আলমের পক্ষে অবস্থান নেন। সেখান থেকে দলে গ্রুপিং শুরু হয়। সম্পাদক বারবার দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় সংগঠনকে সেভাবে চাঙ্গা করতে পারিনি। বিভক্তির কারণে শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, ইউনিটের সম্মেলন দেওয়ার মতো কাজ করতে পারিনি।
 
তবে, আঞ্চলিক সংগঠনে গোপন সম্পৃক্ততা, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, বিভিন্ন ইউনিট থেকে মাসোহারা আদায়সহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সাক্ষাতে কথা বলবেন জানালেও আর দেখা করেননি।

সভাপতি-সম্পাদক দু’জন আগামী নভেম্বরের মধ্যে জেলা উপজেলার প্রত্যেকটা ইউনিটের সম্মেলন দিয়ে নতুন নেতৃত্বের কাছে দলের ভার তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
 
খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, পৌর নির্বাচন থেকে ছাত্রলীগে যে গ্রুপিং সৃষ্টি হয়েছিল, তা সংগঠনটিকে আলাদা করে ফেলেছে। বিষয়গুলো আমরা কেন্দ্রেও জানিয়েছিলাম। আপাতত আমরা বলেছি, দ্রুত জেলা উপজেলার সম্মেলনগুলো দিতে। নতুন নেতৃত্ব আনা গেলে সংগঠন চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
এডি/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।