ঢাকা, সোমবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩২, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ২২ শাওয়াল ১৪৪৬

সারাদেশ

দিনাজপুরে ভবেশ রায়ের মৃত্যু: তিনদিন পর মুখ খুলেছে পরিবার

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
দিনাজপুরে ভবেশ রায়ের মৃত্যু: তিনদিন পর মুখ খুলেছে পরিবার

দিনাজপুর: পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুর তিনদিন পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন তার স্বজনরা। আঘাতের মাধ্যমে ভবেশকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

 

এছাড়া তাকে মোটরসাইকেলে করে যারা বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুজনের নামও প্রকাশ করেছেন তারা। এতদিন ভয়ে মুখ না খুললেও এবার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চান পরিবারের সদস্যরা।  

রোববার (২০ এপ্রিল) দুপুরে বিরল উপজেলার শহরগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের বাসুদেবপুর গ্রামের নিহত ভবেশ চন্দ্র রায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশীর ভিড় লেগে আছে। সবার চোখে মুখে শোকের ছায়া।  

ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন ভবেশ চন্দ্র রায়ের স্ত্রী সান্ত্বনা রানী। আহাজারি করতে করতে বলেন, আমার ছেলেটার কেউ থাকল না।  

তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মেয়েটি মারা গেছে অসুস্থতাজনিত কারণে। আর এখন স্বামীকে হারালেন তিনি।

নিহতের ছেলে স্বপন রায় বলেন, আমার বাবাকে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে গেল। পরে অসুস্থ হয়ে গেল, এটি তো স্বাভাবিক মৃত্যু না। এমনটি কেন হলো, আমরা এর বিচার চাই।  

প্রথমদিকে কেন অভিযোগ করেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সেই সময়ে সব কিছুই জানতাম না। যে এলাকায় বাবাকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই এলাকার লোকজন পরে বলেছে, বাবাকে টর্চার করা হয়েছে। তখন আমরা ভয়ের মধ্যে ছিলাম। ভবিষ্যতে আমারও সমস্যা হতে পারে ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন এলাকাবাসী বলছে যে ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন। বাবার সৎকার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এখন মামলা করব।

নিহতের স্ত্রী সান্ত্বনা রানী রায় বলেন, আমার স্বামী ২৫ হাজার টাকা নিয়েছিল সুদের ওপর। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে ৩২৫০ টাকা দিতে হয়। দেরি হলে আতিক এসে হুমকি দেয়। তারা আমার স্বামীকে মারি ফেলছে। যদি মারি না ফেলায়, সুস্থ মানুষটা যাই কি একবারে মরা আসে বাড়িতে? জীবিত পাই নাই তো স্বামীকে। একবারে মরাই পাইছি। এইটা মানি নেওয়া যায়? আমরা দোষীদের কঠিন শাস্তি চাই।  

নিহত ভবেশ চন্দ্র রায়ের জামাতা রঞ্জিত রায় বলেন, গত বৃহস্পতিবার কিছু ছেলে আমার শ্বশুরকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। একটি বাজারে কথা কাটাকাটি হয়, তারপরে নাড়াবাড়ি বাজারে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতন করার পর পরিস্থিতি খারাপ হলে আমার শ্যালককে ফোন দিয়ে অসুস্থতার কথা বলে। এরপর ফুলবাড়ী বাজারে পৌঁছে দেওয়া হয়, এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিলে ডাক্তার জানায় যে তার মৃত্যু হয়েছে। আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব। দোষীদের মধ্যে একজনের নাম রতন, একজনের নাম আতিক। সঙ্গে পাঁচ-ছয়জন রয়েছে।  

বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস ছবুর বলেন, নিহতের পরিবার যখন খুশি তখন এজাহার দেবে। আমরা সুরতহাল করেছি, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে। সুরতহালে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না।

এ বিষয়ে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মারুফাত হুসাইন বলেন, এ ঘটনায় এখনও কেউ মামলা করননি, অভিযোগও দেননি। মামলা করলে মামলা নেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে স্থানীয় দুই যুবকসহ চারজন দুটি মোটরসাইকেলে করে ভবেশের বাড়িতে আসেন। এরপর বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী বাজারে যাওয়ার কথা বলে ভবেশকে তাদের মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যান তারা। এরপর রাতে তার অসুস্থতার খবর পায় পরিবার। পরে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক ভবেশকে মৃত ঘোষণা করেন।  

এদিকে পেশায় কৃষক ভবেশের মৃত্যুতে তাকে ‘হিন্দু নেতা’ উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি বিবৃতি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।  

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায়ের অপহরণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।

এই হত্যাকাণ্ড একটি পদ্ধতিগত নির্যাতনের অংশ, যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিয়মিতভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে, অথচ পূর্ববর্তী এমন ঘটনার অপরাধীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানাই এবং আবারও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, কোনো অজুহাত না দেখিয়ে বা বৈষম্য না করে সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়— বিশেষ করে হিন্দুদের— সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব।
তাছাড়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালও নিজের এক্স হ্যান্ডলে থেকে এই বার্তা শেয়ার করেন।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এমন বার্তার পর দেশটির সংবাদমাধ্যম গুলো এই ‘হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে তুলকালাম লাগিয়ে রেখেছে এবং যথারীতি অতিরঞ্জিত, একপেশে ও ধারণা নির্ভর খরব প্রকাশ করে চলেছে তারা।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, সংখ্যালঘুদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার যেন থামার নামই নেই পড়সি দেশে। দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় একজন হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে নির্মমভাবে নির্যাতন করে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভবেশ চন্দ্র নামে ওই ব্যক্তি এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের বিরল ইউনিটের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।  
আর এপিবিএন বলছে, ভবেশ চন্দ্রকে অপহরণের পর পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। গোটা ঘটনায় উত্তেজনায় বাংলাদেশে নাকি নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।  

এছাড়া এনডিটিভি, দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ফাইনেন্সিয়াল এক্সপ্রেসের মত প্রায় সব শীর্ষ স্থানীয় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলোতে অধিকাংশ সময়ই বাংলদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে।    

দিনাজপুরে ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় ভারত সরকারের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সব ধর্মের নাগরিকদের সমান অধিকার নিশ্চিত করে।  

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভবেশ চন্দ্র রায়ের মৃত্যুকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর ‘সংগঠিত নিপীড়নের ধারাবাহিকতার’ অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মুখপাত্র শফিকুল আলম বলেন, আমরা এই ভিত্তিহীন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করছি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ এমন দেশ নয়, যেখানে সংখ্যালঘুরা সরকারের সমর্থনে কোনো বৈষম্যের শিকার হন।
প্রেস সচিব পুনরায় উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ সরকার সকল নাগরিককে তার ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে অধিকার রক্ষা করে।
তিনি বলেন, এই নির্দিষ্ট ঘটনায়, আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ভুক্তভোগী পূর্বপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলেন। তার পরিবার কারো সঙ্গে বাইরে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহজনক বিষয় জানাননি।
শফিকুল আলম জানান, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শরীরে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
তবুও, মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে ভিসেরা বিশ্লেষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান এবং বলেন, ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি, ঘটনাটি নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার জন্য।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
এসআই


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।