ঢাকা, বুধবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২, ০২ জুলাই ২০২৫, ০৬ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

‘বউ মিছিলে যাচ্ছি, দোয়া করো’

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২০, জুলাই ১, ২০২৫
‘বউ মিছিলে যাচ্ছি, দোয়া করো’ শহীদ সোহানুর রহমান খান রঞ্জু ও তার পরিবার

জুলাই আন্দোলনের শুরুতে গ্রেপ্তার এড়াতে রাতে বাসায় থাকতেন না সোহানুর রহমান খান রঞ্জু। আগস্টের ৩ তারিখ রাতেও বাইরে ছিলেন।

পরদিন ৪ আগস্ট সকালে বাসায় আসেন। গোসল করে এক জায়াগায় বসে খাওয়া দাওয়া করি। দুজনে অনেক গল্পও করি। ও বলছিল মিছিলে যাবো, আমি নিষেধ করেছিলাম দরকার নেই, গোলাগুলি হবে, বিপদ আসবে। তখন ও বলে, আজ গোলাগুলি হবে না। আমরা সবাই যাবো মিছিলে। আমি আর বাধা দেই নাই। খাওয়া শেষে যাওয়ার পথে খুব আবেগ নিয়েই বলছিল, বউ মিছিলে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া করো।  
আমি বললাম, এসব কথা এভাবে কেন বলছো? 
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে বলে, মানুষের হায়াত-ময়ুতের কথা বলা যায় না। যাচ্ছি হয়তো ফিরে নাও আসতে পারি।  

চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে শাহাদৎ বরণকারী সিরাজগঞ্জের যুবদল নেতা সোহানুর রহমান খান রঞ্জুর (৪০) স্ত্রী মৌসুমী খাতুন (৩২)।

সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার মাসুমপুর দক্ষিণপাড়া মহল্লার বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় মৌসুমী খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি তখনও বুঝি নাই, তার এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হবে। মিছিলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আমি ফোন দিয়ে খোঁজ নেই, তুমি কোথায় আছো, কি অবস্থায় আছো। ও বলে আমি ভালো আছি, পুলিশ আছে আমার সঙ্গেই আছে। আজ গোলাগুলি হয় নাই, টেনশন করো না। আধাঘণ্টা পর বাড়ির বাইরে এসে ছেলেপেলেরা চিৎকার করে বলে রঞ্জু ভাইয়ের গুলি লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইয়া ঘটনাস্থলে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনি তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি রঞ্জু আর নেই। গুলি করার পর তাকে অনেক মারধর করেছে। ডান চোখে গুলি করছিল, সামনে থেকে লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে।  

মৌসুমী খাতুন বলেন, আমার দুই বছর ৭ মাস বয়সী মেয়ে সুমাইয়া খান রোজা এখনো বাবার কথা ভুলতে পারছে না। মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে বলে বাবা কবে আসবে, কেন আসে না। খেতে বসে ওর বাবার ছবি দেখে বলে বাবা এসো খাবা নাকি এসো। এসব দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।  বিয়ের ৮ বছর পরে অনেক সাধনায় আমাদের একমাত্র সন্তান রোজার জন্ম হয়। রঞ্জু মেয়েকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। মেয়েটিও বাবা বলতে পাগল ছিল। এখনো ও বাবার ফেরার অপেক্ষায় থাকে। প্রতিদিনই বাবার কথা বলে। বিভিন্ন আশ্বাস দিয়ে ওকে খাওয়াতে হয়। রাতে বাবা আসবে এই কথা বলে ঘুম পাড়াতে হয়।  

মৌসুমী আরও বলেন, আমার স্বামী ছিলেন সৎ। গরিব দুঃখীকে সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করতেন। চেষ্টা করতেন মানুষের ভালো করার। তার মতো একজন মানুষকে হত্যা করা হলো। তিনি বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ ও ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, জামায়াত থেকে দুই লাখ, বিএনপি থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছি। তবে একটি চাকরি পেলে মেয়ের ভবিষ্যত গড়া সম্ভব হবে।  

সোহানুর রহমান খান রঞ্জু সিরাজগঞ্জ শহরের মাসুমপুর দক্ষিণপাড়া মহল্লার মৃত মাজেদ খানের ছেলে। বাবা ও মা অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তিনি ঢাকায় একটি ডেন্টাল ক্লিনিক পরিচালনা করতেন। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ নিউমার্কেটে ‘খান ডেন্টাল নামে আরেকটি ক্লিনিক চালু করেন। তিনি সিরাজগঞ্জ পৌর যুবদলের সহ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।  

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সকালে স্বৈরাচার পতনের এক দফা আন্দোলনে মিছিলে যোগ দেন রঞ্জু। বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতার সঙ্গে শহরের বাজার স্টেশন এলাকায় মিছিল নিয়ে অংশ নেন তিনি। ধীরে ধীরে মিছিলটি শহরের এস এস রোড এলাকায় যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এস এস রোডস্থ আওয়ামী লীগ অফিস এলাকায় গেলে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের লোকজন হামলা এবং গুলি চালায়। তাদের ছোড়া একটি গুলি রঞ্জুর ডান চোখে লেগে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে ৬ আগস্ট সকালে কান্দাপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।  

সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মাসুমপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি ইবনে জায়েদ হাসু বলেন, ৪ আগস্ট এলাকা থেকে আমরা মিছিল নিয়ে যাই। রঞ্জু আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমাদের অবস্থান ছিল বাজার স্টেশন এলাকায়। কিন্তু রঞ্জু কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এস এস রোডে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে এগিয়ে যায়। আমি যেতে নিষেধও করেছিলাম। কিন্তু শোনেনি। কিছুক্ষণ পরেই খবর এলো রঞ্জুকে গুলি করা হয়েছে। সে দলের একজন ভালো কর্মী ছিল। ব্যবহারও অত্যন্ত ভালো। কখনোই কারও ক্ষতি করে নাই।  

এসআই প্রণয় কুমার বলেন, এই হত্যা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবু, সাবেক পিপি-জিপি, ইউপি চেয়ারম্যানসহ একাধিক আসামি গ্রেপ্তার রয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে চলছে বলে জানান তিনি।  

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, রঞ্জু যুবদলের বলিষ্ঠ কর্মী। সে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে তাকে হত্যা করেছে। আমরা দ্রুত এই হত্যার বিচার দাবি করি।  

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।