বরিশাল: স্বৈরাচার শেখ হাসিনাবিরোধী অভ্যুত্থান চলাকালে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই প্রথমে ঢাকার রামপুরা ব্রিজ এলাকায় পায়ে গুলি লেগে আহত হন হাসান সর্দার। এরপর কদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত লগ্নে আবার আন্দোলনে যান।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা এই জুলাইযোদ্ধা বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের পতিহার গ্রামের দরিদ্র মৃত মানিক সরদারের ছেলে। জুলাই আন্দোলনে আহত হওয়ার পর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা ও সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র-সিআরপিতে থেরাপি নেওয়ার পর বর্তমানে তিনি গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বাবাহারা হাসান তার অভ্যুত্থানকালের স্মৃতিচারণ করেন। পাশাপাশি আহত হওয়ার পর চিকিৎসা করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়াসহ সংসারে অভাব-অনটনের কথা তুলে ধরেন তিনি।
হাসান সর্দার জানান, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার রামপুরা ব্রিজের কাছাকাছি স্থানে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। আর সেই গুলি পায়ে লেগে আহত হন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আহত হলেও হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে ভয় পেয়েছি। কারণ পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে সেই আতঙ্কে ছিলাম সবসময়। একটি বাসায় বসে আমিসহ আরও কয়েকজন এক চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নেই। একটু সুস্থ হয়ে ৫ আগস্ট আবার আন্দোলনে যাই। ওই দিন আন্দোলনে বাড্ডা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপরে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। আমার ডান হাতে, পাঁজরে এবং মুখমণ্ডলে পুলিশের ছোড়া গুলির স্প্লিন্টার লাগে। এতে আমি হলে রক্তাক্ত জখম হলে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে যায়। ’
উদ্ধারকারীদের বরাতে হাসান সর্দার বলেন, ‘প্রথমে আফতাবনগর নাগরিক হাসপাতালে নিলেও জ্ঞান না থাকায় উদ্ধারকারীরা মনে করেছিল আমি মারা গেছি। ওই দিন আমাকে নাগরিক হাসপাতালের ফ্লোরে ফেলে রাখা হয়। তারপরে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন ৬ আগস্ট ভর্তি করা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। ওই রাতে অপারেশন করার কথা বলে আমাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যায়। কিন্তু অপারেশন না করে সে রুম থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়। ৭ আগস্ট সকালে আমাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কুর্মিটোলা হাসপাতাল আমাকে ভর্তি না করে আবার পুনরায় পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। ৭ আগস্ট রাতে পুনরায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হই। কয়েকদিন পরে আমাকে সাভারের সিআরপিতে পাঠায় থেরাপি দেওয়ার জন্য। সেখানে থেরাপি শেষে আবার পঙ্গু হাসপাতালে চলে আসি। পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরে একটু সুস্থ হই। ’
ধারদেনা করে চিকিৎসা করিয়েছি, ঘরে খাবারও ছিল না
হাসানরা তিন ভাই-বোন। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে হাসান সবার বড়। বাবাহীন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন হাসান সর্দার। দুই ভাইবোন কলেজে লেখাপড়া করছে।
হাসান জানান, পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে তিনি আজ কর্ম করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। ফলে এখন তার ছোট-ছোট ভাইবোনকেও অনেকটা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘বাড়িতে আসার আগে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন- আমার শরীরে যে গুলি রয়েছে তা বাংলাদেশে অপারেশন করে বের করা সম্ভব হবে না। আমার হাতে ও শরীরে প্রায় ৪শ’ স্প্লিন্টার রয়েছে। এখন আমাকে বিদেশে চিকিৎসা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। আমি ধারদেনা করে চিকিৎসা করিয়েছি। বাড়িতে আসার পর কেউ কোনো খবর নেয়নি। টাকার অভাবে আমার ভাই-বোনের কলেজের ফি দিতে পারিনি। আমার ঘরে খাবার ছিল না। ’
তিনি জানান, স্প্লিন্টারের কারণে এখন রাতের বেলা ঘুমাতে পারেন না, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এখন প্রতিটি রাত কাটছে তার। যে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাইলেও যেন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিখন বণিক জানান, মো. হাসান সর্দার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তিনি আমাদের সরকারি তালিকাভুক্ত একজন আহত ব্যক্তি। বাংলাদেশ সরকার তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চলতি মাসে সিঙ্গাপুর পাঠাবে।
এমএস