যশোর: নির্বাচনী আসন যশোর-১ (শার্শা) এ অনেক আগেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। গত ৮ আগস্ট খেলাফত মজলিসও দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে।
তবে, বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনো কোনো প্রার্থী তালিকা ঘোষণা না করায় এই আসনে দলের প্রার্থী কে হচ্ছেন তা নিশ্চিত না। এই আসনে বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয় পাওয়ায় চেষ্টা চালানোদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন নেতার নাম শোনা যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত দল যাকেই মনোনয়ন দেবে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তার পক্ষেই অবস্থান নিয়ে কাজ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটা যতটা সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যশোর-১ আসনে বিএনপির প্রার্থিতা ঘোষণা ততটাই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। ‘শেষ মুহূর্তের খেলা’য় একক প্রার্থী নিয়েই ভালোভাবে বিএনপি ভোটের মাঠে সক্রিয় হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন দলের নেতারা।
একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত শার্শা উপজেলা। আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। আগের ১২টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নয়বার, বিএনপি তিনবার এবং জামায়াতে ইসলামী একবার এই আসন থেকে জয়লাভ করে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের আমলে ভোটার বিহীন তিনটি নির্বাচনও তালিকায় রয়েছে। রয়েছে বিএনপি আমলের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেরও হিসেব। এছাড়া, স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলের ‘সাহেব-বিবি-গোলাম’ এর পাতানো দুই নির্বাচনও বাদ যায়নি হিসেব থেকে।
১৯৭৩ সালে যশোর-১ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রয়াত তবিবর রহমান সরদার। এছাড়া, তিনি ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয় আসনটি। বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির আলী কদর। এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হন বিএনপির তৎকালীন কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি। তারও আগে ১৯৯৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নূর হুসাইন। ১৯৮৮ সালের কেএম নজরুল ইসলাম স্বতন্ত্র হিসেবে এরশাদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হয়েছিলেন।
আসনটি ফের আওয়ামী লীগের দখলে আসে শেখ আফিল উদ্দিনের হাত ধরে ২০০৮ সালে। সেবার জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা আজিজুর রহমানকে মাত্র পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন আফিল উদ্দিন। সেটিও সম্ভব হয়েছিল উপজেলা জামায়াতের রাজনীতিতে প্রবল প্রভাবশালী আকিজ পরিবারের সন্তান আফিল উদ্দিনের পক্ষে তার ভাই-বোন-আত্মীয়-স্বজনেরা প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করায়।
২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের পাতানো ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে শেখ আফিল উদ্দিনকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ফের বিজয়ী ঘোষণা করে আনে আওয়ামী লীগ।
তবে, পরিস্থিতি এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৫ আগস্টের ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের তোড়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে পালানো আওয়ামী লীগের আর এবারের নির্বাচনে যে অংশ গ্রহণ করা হচ্ছে না, তা এক প্রকার নিশ্চিত। ছাত্রজনতার ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোয় মানবতাবিরোধী অপরাধে দলটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। সে কারণে ভোটের রাজনীতিও পাল্টে গেছে। যশোর-১ আসনও এর বাইরে নয়। ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
ভারতীয় সীমান্তবর্তী যশোর-১ (শার্শা) আসনে এবার জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আজিজুর রহমান। তিনি দলের পক্ষে এই আসন থেকে ২০০৮ সালে নির্বাচন করেছিলেন। এবারও জামায়াতে ইসলামী আসনটিতে মাওলানা আজিজুর রহমানের ওপর আস্থা রাখছে।
ইতিমধ্যে, মাওলানা আজিজুর রহমানের পক্ষে নির্বাচনী ময়দান চষে বেড়াচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। তারা বিভিন্নভাবে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রকাশ্য সভা থেকে শুরু করে অনলাইন প্রচারণা-কোনো কিছুই বাদ রাখছেন না। চলছে কেন্দ্রভিত্তিক কর্মীসভা, আলোচনা ও মতবিনিময়ও।
বাংলানিউজকে মাওলানা আজিজুর রহমান বলেন, ‘দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছি। ক্ষমতায় গেলে আমরা যে কাজগুলো করতে চাই সে সম্পর্কেও বলছি। পাশাপাশি আমি ব্যক্তিগতভাবে উপজেলাবাসীকে দল-মত, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। ’
তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হয়ে যতবেশি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে তত বেশি হানাহানি বা হিংসাত্মক কার্যক্রম কমে আসবে। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সে কারণে কর্মী সম্মেলন, দায়িত্বশীল সমাবেশগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। ’
এই আসনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস প্রার্থী হিসেবে দলের শার্শা উপজেলা সভাপতি মাওলানা মাহাবুবুর রহমানের নাম ঘোষণা করেছে। গত ৮ আগস্ট শুক্রবার খুলনায় বিভাগীয় ৩৬টি সংসদীয় আসনের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাথে মতবিনিময় শেষে এই ঘোষণা দেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দলের শার্শা উপজেলা সভাপতি বখতিয়ার হোসেন। দলের যশোর জেলা সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা শ্রমিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম গাজী বাংলানিউজকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। শুরুতে তিনজন নেতার নাম শোনা গেলেও এখন অন্তত পাঁচজন নেতার কথা শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন দলের সাবেক কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক এমপি মফিকুল হাসান তৃপ্তি, দলের শার্শা উপজেলা সভাপতি হাসান জহির, সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটন, সাবেক সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মহাসিন কবির।
দলের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, শার্শা উপজেলা বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে শেষ পর্যন্ত লড়াইটা হবে ত্রিমুখি-মফিকুল হাসান তৃপ্তি, হাসান জহির এবং নুরুজ্জামান লিটনের মধ্যে। তাদের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে মফিকুল হাসান তৃপ্তির জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি উপজেলায় অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু, আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির কারণে সকালের পরপরই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে তিনি নির্বাচনী ময়দান ত্যাগ করেন সেবার।
হাসান জহিরের সাথেও তৃণমূলের ঘনিষ্টতা রয়েছে। তিনি দুইবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
তরুণ নেতা হিসেবে নুরুজ্জামান লিটন বেশ জনপ্রিয়। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি উপজেলা ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যুবদলেরও নেতৃত্বে ছিলেন। উপজেলাব্যাপী তার রয়েছে বিপুল কর্মীবাহিনী। বিশেষ করে শার্শার উত্তরাঞ্চলে বিএনপির রাজনীতি এককভাবে বলা চলে নুরুজ্জামান লিটনের দখলে।
দলের শার্শা উপজেলা কমিটির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা খায়রুজ্জামান মধুর আগের সেই জৌলুস এখন আর নেই বললেই চলে। আর মহসিন কবির অনেক দিন থেকেই এলাকায় সেইভাবে খুব একটা সক্রিয় নন।
সাবেক এমপি মফিকুল হাসান তৃপ্তি নিজের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন বাংলানিউজের কাছে। বলেছেন, ‘বিএনপি একটা বড় দল। একাধিক নেতা মনোনয়ন পেতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। তবে, দলের প্রতি নিবেদন, ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পালন ও ত্যাগ স্বীকার দল মূল্যায়ন করবে বলে বিশ্বাস করি’।
তিনি বলেন, ‘আমি এই জনপদের সন্তান। এখানেই বড় হয়েছি। কখনো মাদক, সন্ত্রাস বা অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি। দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন মন্ত্রী, এমপি না হয়েও সর্বোচ্চ উন্নয়নের চেষ্টা করেছি। উপজেলাবাসী এটা ভালোভাবেই মনে রেখেছে। এটিও মনোনয়ন পাওয়ার পক্ষে ভূমিকা রাখবে’।
তবে, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই কাজ করবেন জানিয়ে মফিকুল হাসান তৃপ্তি বলেন, ‘সবার আগে দল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যার হাতে ধানের শীষ তুলে দেবেন তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধ থেকে সবাই কাজ করবো’।
শার্শা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটনও দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের কাছে আমার অবস্থান ভালো। দুঃসময়ে এলাকাবাসীর পাশে ছিলাম। দলের নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। নেতাকর্মীরা যখন হামলা, মামলায় জর্জরিত তখন পাশে থেকে সহযোগিতা করেছি। নিজেও দীর্ঘদিন কারাগারে থেকেছি। এগুলো দল অবশ্যই বিবেচনায় রাখবে’।
নুরুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বিএনপি এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইয়াং নেতৃত্বকে সবসময় সামনে এগিয়ে দিতে চান। ফলে একজন তরুণ হিসেবে আমার অনেক কিছুই দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সব ঠিক থাকলে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার সম্ভাবনা দেখিনা’।
‘মূল ভিত্তি দল’ উল্লেখ করে লিটন বলেন, দেশের স্বার্থে দল যাকে মনোনয়ন দেবে সর্বোচ্চ দিয়ে আমরা সবাই সেই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করবো’।
এসএইচ