যশোর: দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে যশোর-৪ সংসদীয় আসনে বিএনপি বেশ বিপাকেই রয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সিনিয়র যুগ্মসম্পাদক প্রকৌশলী টিএস আইয়ূব ও অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফারাজী মতিয়ার রহমান ধানের শীষের প্রার্থী হওয়ার জন্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে, বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে জামায়াতে ইসলামী। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই দলের যশোর জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। দলটি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির সুযোগকেও কাজে লাগানোর কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে। ফলে নির্বাচনের আগেই অন্যরকম এক লড়াই চলছে যশোর-৪ আসনে।
এই আসনে ইতিমধ্যে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় আইনজীবী পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট বায়েজিদ হুসাইন। খেলাফত মজলিস প্রার্থী করেছে আশিক ইলাহীকে। আলোচনায় আছেন বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট জহুরুল হক জহির এবং বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির (বিএমজেপি) সভাপতি সুকৃতি কুমার মন্ডল।
বাঘারপাড়া এবং অভয়নগর উপজেলা নিয়ে গঠিত যশোর-৪ নির্বাচনী আসন। এর সাথে রয়েছে সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়ন। নির্বাচনী আসনটির দুই উপজেলায় দুই ধরনের আর্থসামাজিক অবস্থা। বাঘারপাড়া সবজি উৎপাদন জোন হিসেবে পরিচিত। ধানসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনেও এই উপজেলা সমাদৃত। শিল্পপ্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে উপজেলাবাসীর কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সবজি সংরক্ষণাগার না থাকায় উৎপাদিত সজবি নিয়ে প্রতি বছরই কৃষকদেরকে বিড়ম্বনা ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
অভয়নগর উপজেলা নৌবন্দর আর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সমৃদ্ধ। বাইরে থেকে আমদানি করা সার, চাল, গম, কয়লা ইত্যাদি পণ্য আনলোড করা হয় উপজেলার নওয়াপাড়া নৌবন্দরে। এখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। নওয়াপাড়ায় রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রি (জেজেআই), আকিজ জুট মিল, কার্পেটিং জুল মিল ইত্যাদি। রয়েছে একাধিক সিমেন্ট কারখানাও। দুটি চামড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানও আছে এই উপজেলায়। তবে, শিল্প শহরটির অনেক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় স্থানীয় মানুষের মধ্যে বেকারত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। কৃষিতে অভয়নগরের অবদান থাকলেও বড় এক প্রতিবন্ধকতার নাম মনুষ্যসৃষ্ট ভবদহের জলাবদ্ধতা। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠতে পারে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনী ইস্যুর আগের ইস্যু হয়ে উঠেছে বিএনপি থেকে কে মনোনয়ন পাবেন তা নিয়ে। তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে বলেই মনে করেন তারা।
যদিও স্থানীয়দের অধিকাংশই বলেছেন, বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন প্রকৌশলী টি এস আইয়ূব। তিনি ২০০৮ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। মাত্র পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী রণজিৎ রায়ের কাছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন টি এস আইয়ূব। কিন্তু, সেবার আওয়ামী লীগের সাজানো নির্বাচনী ময়দানে তিনি, তার নির্বাচনী কর্মী এবং বিএনপি-জামায়াতের কোনো ভোটার মাঠে দাঁড়াতে পারেননি। দীর্ঘদিন থেকে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে দলমতনির্বিশেষে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। তবে, হাল আমলে এসে নিজ দলের একটা অংশের চরম বিরোধিতার মুখেও পড়তে হচ্ছে টি এস আইয়ূবকে।
এবার টিএস আইয়ূবকে প্রকাশ্যে শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বিএনপির অভয়নগর উপজেলা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় পাটকল শ্রমিক দলের ভাইস চেয়ারম্যান ফারাজী মতিয়ার রহমান। আসন্ন নির্বাচনে তিনি ‘অভয়নগরের প্রার্থী চাই’ ইস্যুকে সামনে এনে বলছেন বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই উপজেলা থেকে দলের কোনো প্রার্থী দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তিনি স্থানীয় নেতাকর্মীদেরকে সংগঠিত করারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া, টিএস আইয়ূবকে ঋণ খেলাপি অভিহিত করে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হতে পারেন বলেও মন্তব্য করেছেন। সে কারণে এবার তিনিই এই আসনে হতে যাচ্ছেন বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী-বাংলানিউজকে এমনই বলেছেন ফারাজী মতিয়ার রহমান।
ফারাজী মতিয়ার রহমান বলেছেন, ‘তারেক সাহেব ব্যাংক ডিফল্টারকে মনোনয়ন দেবেন না। সে হিসেবে আমিই মনোনয়ন পাবো’।
অন্যদিকে, টি এস আইয়ূব বাংলানিউজকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘মিথ্যা কথা। ব্যাংকে আমার কোনো খেলাপি নেই। ’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতিকদের বড় সম্পদ জনসম্পৃক্ততা। অন্য যারা এই আসন থেকে মনোনয়ন চাচ্ছেন তাদের অধিকাংশেরই তা নেই। দু-একজনের যাদের আছে তাও খন্ডিত। তারা আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন না। আবার প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকলে কেউই ভোটের কথা বলতেন না। পক্ষান্তরে আমি ১৯৯৭ সাল থেকে এই আসনে দলকে সংগঠিত করে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছি। এটা কেন্দ্র ভালোভাবেই জানে। ফলে আমি ছাড়া আর কারোর মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ’
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অনেকে জানিয়েছেন, এবার টিএস আইয়ূবের বিপক্ষে শক্তিশালী একটা গ্রুপ অবস্থান নিয়েছে। এই গ্রুপে রয়েছেন বাঘারপাড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক দুই চেয়ারম্যান আবু তাহের সিদ্দিকী ও মশিয়ার রহমান। আছেন বাঘারপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল হাই মনা। এই গ্রুপের প্রত্যাশা শিল্পপতি নাসির উদ্দিনকে এই আসনে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে ভূমিকা পালন করা। এই বিষয়ক একটি প্রস্তাবনা নাকি তারা নাসির উদ্দিনের কাছে নিয়ে গেলে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মনোনয়ন নিশ্চিত হলে বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। শেষ পর্যন্ত নাসির উদ্দিনের মিশন সফল না হলে এই গ্রুপ ফারাজী মতিয়ার রহমানের পক্ষে অবস্থান নিতে পারেন। এক্ষেত্রে মনোনয়ন বিষয়ক চাপ সৃষ্টির জন্য আইয়ূব বিরোধীদের মধ্য থেকে আরও অন্তত দুইজন দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন।
বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে ইতিমধ্যে সামিল হয়েছেন জাতীয়তাবাদী যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম আহ্বায়ক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট নূরে আলম সিদ্দিকী সোহাগ। তিনি সম্প্রতি যশোর শহরের একটি অভিজাত হোটেলে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করে নিজের দলীয় প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন।
এদিকে, বিএনপির এই অবস্থাকে পুঁজি করে এবং আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আসনটি ছিনিয়ে নেওয়ার মিশনে মাঠে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী। এখানে দলের প্রার্থী যশোর জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল। বলা চলে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তিনি পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে এই সংসদীয় এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছেন। সাংগঠনিক কার্যক্রম গোছানোর পাশাপাশি তিনি সাধারণ মানুষের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে নানা কর্মসূচি পালন করছেন। দিচ্ছেন অনুদানসহ নানা সহায়তা। কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের প্রতিনিয়ত সভা করছেন প্রার্থী ও জামায়াতের নেতারা। বিভিন্ন সুধী সমাবেশ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
দুই উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন এবং দুটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত যশোর-৪ সংসদীয় আসনে দীর্ঘ সময় রাজ করেছে আওয়ামী লীগ। এই আসনে ১৯৭৩ সালে এমপি হন শাহ হাদিউজ্জামান। এছাড়া তিনি ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালেও এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে এমপি হন নাজিম উদ্দিন আল আজাদ। এই দল থেকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট থেকে ২০০১ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির (নাফি) এমএম আমিন উদ্দিন। বিএনপি নেতা নাজিম উদ্দিন আল আজাদ পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে ১৯৮৮ এর নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন। এরপর টানা চার মেয়াদ ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এমটি হয়েছিলেন রণজিৎ কুমার রায়।
এসএইচ