ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট এখন আর ভদ্রলোকের হাতে নেই। বিশ্বায়নের যুগে এই খেলাটারও নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ।
কিন্তু তাতে কার কি এসে যায়! কেউ ভেবে দেখতে চাইছেন না অর্থের সঙ্গে ক্রিকেটে কি পরিমাণ অভদ্রতার আমদানি ঘটেছে। এবং সেই অভদ্রতা দেখাছে ক্রিকেটের সবোর্চ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। অভদ্রতার মাত্রাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঐ সংস্থা তার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলো! আর সেটা ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চ বিশ্বকাপের ফাইনালে। আইসিসি’র গঠনতন্ত্রের কথা ভুলে যান, এর ঐতিহ্য আর রীতির প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাশীল হলেও তো বিজয়ী দলের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি তুলে দেয়ার কথা আইসিসি সভাপতি আ.হ.ম. মুস্তফা কামালের। তিনি সশরীরে মাঠে উপস্থিতও ছিলেন। তবুও তাকে ট্রফি দিতে দেয়া হলো না! ট্রফি দিলেন আইসিসির হাইব্রিড চেয়ারম্যান ভারতের বির্তকিত এবং সর্বোচ্চ আদালত থেকে বার বার তিরস্কৃত এন শ্রীনিবাসন। আইপিএল গড়াপেটাকান্ডে যার জামাতা জেল খেটেছেন, যিনি নিজে বিসিসিআই থেকে পদ হারিয়েছেন সেই শ্রীনিবাসন বহু আগেই লাজ লজ্জাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। তারপরও এমসিজি-তে উপস্থিত থাকা ৯৩ হাজার ১শ ১৩ জন দর্শকের মধ্য থেকে দুয়ো ধ্বনি উঠলো, তাঁর নাম যখন উচ্চারিত হলো ট্রফি দেয়ার জন্য। শ্রীনিবাসনের মতো লোকের বিরুদ্ধে আইসিসি সভাপতি মানহানির মামলা হয়তো করলেন না। কিন্তু গণ আদালতের রায় নিশ্চয়ই ক্রিকেটবিশ্ব দেখেছে এবং শুনেছে টেলিভিশনের সৌজন্যে। একজন শ্রীনিবাসন ক্রিকেটমঞ্চকে ব্যবহার করে একজন ব্যক্তি মু¯তফা কামালকে অপমানিত করার অপচেষ্টা করলেন, বিষয়টা মোটেও তা নয়। তিনি ক্রিকেট প্রশাসনকে বির্তকিত করলেন। ক্রিকেট খেলাটার উপর মানুষের আস্থা আর বিশ্বাসের ভিতটাও নাড়িয়ে দিলেন। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, টাকা থাকলে ক্রিকেটে সবই সম্ভব! টাকার জোরে ক্রিকেট কর্তারা সবই পারেন। ক্রিকেট এখন নিছক আর একটা খেলা নেই।
সত্যিই তাই। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ নিয়ে যা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে তার যা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, তাতে ক্রিকেট কি শুধু খেলা? দেশের সাধারণ মানুষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তি পর্যন্ত বিষয়টাকে যেভাবে দেখছেন, তাতে প্রতিবেশী দু’টো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনীতি-রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব কিছুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে এমসিজি’র ঐ কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ! বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস ম্যাচটা আম্পায়াররা হারিয়ে দিয়েছেন! এমনটা বিশ্বাস করার অনেক ‘অনুঘটক’ ছিল ঐ ম্যাচে। কিন্তু দিন শেষে কেউ ভাবতে চাইলেন না ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তও খেলাটার অংশ। আর সেটা মেনে নিয়েই ক্রিকেটটা খেলতে হয়। এ-কারণে আমরা সবাই এখন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো ঐ একটা ম্যাচ নিয়েই ঝাঁকুনি দেয়ার চেষ্টা করছি। এতে কি আমাদের ক্রিকেটের খুব বেশি লাভ হচ্ছে! এবারের বিশ্বকাপে একটা ম্যাচের হারকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা আমাদের ক্রিকেটের ফোকাসটা হারিয়ে ফেলছি কি না সেটা ভেবে দেখা উচিৎ। ক্রিকেট এই দেশে শুধু একটা খেলা না। তার চেয়ে বেশি কিছু। এ-কারণে আমাদের আবেগের বুদ্বুদটাও বেশি। যারা পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতলো সেই অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে এই উপমহাদেশের মানুষের পার্থক্যটা ওখানেই। অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও সেখানখার মানুষ এতোটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মাইকেল ক্লার্কদের কাজ ছিল অস্ট্রেলিয়াকে চ্যাম্পিয়ন করা। ওরা সেটা করেছে। ব্যস। আমাদের কাজ আগামী বিশ্বকাপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পরিকল্পনা ঠিক করা আমরা সেটা করছি। অর্থাৎ, বর্তমানে দাঁড়িয়ে ওরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। আর আমরা বর্তমানে থেকেও অতীতমুখি হয়ে যাচ্ছি! সময় এসেছে সামনের দিকে তাকানোর। বাংলাদেশ ভাল ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলেছে এবারের বিশ্বকাপে। তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মাহমুদউল্লাহ-রুবেল-তাসকিন--- বিশ্বকাপে এই নামগুলো যথেষ্ট সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে। এটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় প্রাপ্তি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, বিশ্বকাপের ঐ পারফরম্যান্স ফিক্সড ডিপোজিট না যে ওটা ভাঙিয়ে বেশ কিছু দিন চলা যাবে। পাকিস্তান সিরিজে খারাপ করলেই কিন্তু বহুলোক পাওয়া যাবে যারা বলবেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট এখনো ঠিক জাতে ওঠেনি। তাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে ভাল করতেই হবে।
আইপিএল খেলতে ভারত যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান কিছু কথা বলে গেছেন। আম্পায়ারিং নিয়ে তিনি যা বলেছেন সেটাই ক্রিকেটের স্পিরিট। আবার পাকিস্তান সিরিজ নিয়ে যা বলেছেন, তাতে রয়েছে বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসের স্ফূরণ। পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে এবার বাংলাদেশ ফেভারিট হিসেবেই শুরু করবে। এমন একটা কথা বলেছেন সাকিব। তার কথাটা শুধু যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করার দায়িত্ব দলের বাকি ক্রিকেটারদের।
তবে সবকিছু প্রমাণের দায় শুধু ক্রিকেটারদের নয়। দায় ক্রিকেট কর্তাদেরও আছে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বেশিরভাগ লোকই ঘুরে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড। খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাদের ক্রিকেট অবকাঠামো। ক্রিকেট প্রশাসনের অন্দর মহলেও দু’একজন ঢুঁ মেরেছেন। তারা ক্রিকেটটা কিভাবে পরিচালনা করেন সেটা এখন আর তাদের অজানা নয়। তাই বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন বড় জিজ্ঞাস্য: আমাদের ক্রিকেট শ্রীনিবাসন স্টাইলে চলবে নাকি অস্ট্রেলিয়ানদের প্রফেশনালিজমের ভিত্তিতে চলবে। অস্ট্রেলিয়ানরা ক্রিকেট খেলে এবং খেলাটা বুঝতে চায় স্কিল এবং মেধানির্ভর হয়ে। আমরা অনেক বেশি আবেগনির্ভর। আবেগ সরিয়ে বাস্তবের রুক্ষ জমিনে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকানোর সময় এখন।
২০১৫ বিশ্বকাপ এখন অতীত। বাংলাদেশের লক্ষ্য যদি হয় আগামী বিশ্বকাপে ভাল কিছু করার, তবে সেজন্য এখনই দরকার পরিকল্পনা। আলিম দার’দের আম্পায়ারিং, শ্রীনিবাসনদের অভদ্র জনোচিত ‘দাদাগিরি’-র সবচেয়ে ভাল জবাব পারফরম্যান্স। হ্যাঁ, মাঠে এবং মাঠের বাইরে দু’জায়গায় এখন বাংলাদেশের পারফরম্যান্সটা খুব জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম