জিউফ্রে বয়কট তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্রিন্স অব কলকাতা’। পারিবারিক ডাকনাম ‘মহারাজ’।
ভারতীয় ক্রিকেটে দিনবদলের অধিনায়ক বলা হয় সৌরভ গাঙ্গুলীকে। এখনকার যে সর্বজয়ী ভারত দলটিকে দেখা যায়, এর গোড়াপত্তন হয়েছিল তারই হাত ধরে। সাবেক অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহকে টসের জন্য অপেক্ষায় রাখা কিংবা লর্ডসের ব্যালকনিতে শার্ট খুলে বুনো উদযাপন, সবমিলিয়ে ‘প্রিন্স অব কলকাতা’ যা করেছেন তার অনেক কিছুই আইকনিক।
গাঙ্গুলীর ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল ১৯৯২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে মাত্র ৩ রানে আউট হয়েছিলেন তিনি। দুঃস্বপ্নের সেই শুরুর পর দল থেকেই বাদ পড়লেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে দলের সিনিয়রদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগঅ তোলা হয়েছিল তখন। ‘অহংকারী’ গাঙ্গুলী এরপর ৪ বছর লড়াই করেন দলে ফেরার জন্য। এর মাঝে রঞ্জি ট্রফিতে রানের বন্যা বইয়ে দেন। বাধ্য হয়েই তাকে ডেকে নেন নির্বাচকরা।
১৯৯৬ সালে এক পরিণত গাঙ্গুলীকে পায় ভারত। ক্রিকেটের ‘মক্কা’খ্যাত লর্ডসে টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বসেন তিনি। লর্ডসে অভিষেক হওয়া কোনো খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ রানের (১৩১) রেকর্ডও গড়েন। পরের ম্যাচে ট্রেন্ট ব্রিজে আবারও সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি। অভিষেক সিরিজে পর পর সেঞ্চুরি হাঁকানো মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান তিনি। অফসাইডে শট খেলার দুর্দান্ত দক্ষতার কারণে তার নাম হয়ে যায় ‘কিং অব অফসাইড’।
ভারতের জার্সিতে ১১৩ টেস্ট এবং ৩১১ ওয়ানডে ম্যাচে যথাক্রমে ৭ হাজার ২১৩ এবং ১১ হাজার ৩৬৩ রান করেন গাঙ্গুলী। এই সময়ে ভারতকে বহু ম্যাচ জেতানো ইনিংস আসে তার ব্যাট থেকে।
‘বিপ্লবী’ অধিনায়ক
ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে আগ্রাসী অধিনায়ক ছিলেন গাঙ্গুলী। ২০০০ সালে যখন তার হাতে নেতৃত্বের ভার তুলে দেওয়া হয় তখন ভারতীয় দল ম্যাচ-ফিক্সিং কাণ্ডে জর্জরিত। দলের আত্মবিশ্বাস তখন একেবারেই তলানিতে। চাপ সইতে না পেরে এমনকি নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ব্যাটিং কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। এই কঠিন সময়েই সামনে থেকে লড়াইয়ে নামার জন্য এগিয়ে এলেন গাঙ্গুলী।
চাপে পিষ্ট ভারতীয় দলকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। দলকে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে শেখান তিনি। তখনকার ক্রিকেটবিশ্বের মহাশক্তিধর অস্ট্রেলিয়া দলকে একমাত্র ভারতই সত্যিকারের লড়াই উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার টানা ১৬ টেস্ট জয়ের রেকর্ডও ভেঙে দেয় ভারত।
গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে ঘরে এবং বাইরে সব জায়গায় সাফল্যের দেখা পায় ভারত। ইডেন গার্ডেনে স্টিভ ওয়াহ’র দলের সামনে ফলো-অনে পড়েও ম্যাচ বের করে আনার অবিশ্বাস্য কীর্তিও তার নেতৃত্বেই দেখায় ভারতীয় দল। বাইরের মাটিতেও যে ম্যাচ জেতা সম্ভব সেই বিশ্বাস ভারতীয় খেলোয়াড়দের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ‘প্রিন্স অব কলকাতা’।
গাঙ্গুলীর অধীনে ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট সিরিজে হারানোর স্বাদ পায়। ২০০২ সালে লর্ডসে ইংলিশদের হারিয়ে নেটওয়েস্ট ট্রফি জেতা, ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছানো, ইংল্যান্ডের সঙ্গে ২০০৪ সালে টেস্ট সিরিজে ড্র, এমনকি ২০০৫ সালে পাকিস্তানকে টেস্ট সিরিজে হারিয়ে দেওয়ার স্বাদ তার নেতৃত্বেই পায় ভারত। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে অজিদের কাছে হেরে গেলেও সেবার সৌরভ ৫৮.১২ গড়ে করেছিলেন ৪৬৫ রান।
সৌরভ ভারতীয় দলকে ৪৯টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন ২১টিতে। ১৪৬টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে জিতেছেন ৭৬ ম্যাচে।
বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট
২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর, সবাইকে চমকে দিয়ে বিসিসিআই’র ৩৯তম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন গাঙ্গুলী। এই পদে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ ছিল না। প্রাথমিকভাবে ১০ মাসের জন্য দায়িত্ব নেওয়ার ৮ মাসের মধ্যে তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এখনও চলতি বছরের আইএপিএল আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। করোনার কারণে এবারের আইপিএল দর্শকশূন্য মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
সৌরভ গাঙ্গুলী আর ভারতীয় ক্রিকেটের সম্পর্ক সারাজীবনের। ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে সেই সম্পর্কের পূর্ণতা দিয়েছেন তিনি। অধিনায়ক হওয়ার সময় যেমন, বোর্ড প্রধান হওয়ার সময়ও নানান সমস্যায় জর্জরিত ছিল ভারতীয় ক্রিকেট। কাজটা তাই এবারও সহজ নয়। তবে ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা পুরনো। এর আগে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের (সিএবি) সভাপতি হিসেবে দু’বার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ফলে বিসিসিআই’য়েও তিনি সফল হবেন একথা বলাই যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০২০
এমএইচএম