ঢাকা, বুধবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০২ জিলকদ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সিন্ডিকেট ভেঙে মালয়েশিয়ার দুয়ার খোলার অপেক্ষায় বাংলাদেশ

পিংকি আক্তার, সিনিয়র রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১:৫৭, এপ্রিল ৩০, ২০২৫
সিন্ডিকেট ভেঙে মালয়েশিয়ার দুয়ার খোলার অপেক্ষায় বাংলাদেশ সংগৃহীত ছবি

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় যেমন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নের কর্মস্থল তেমনি এই দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি পদে সিন্ডিকেটের বেড়ি পায়ে পরতে হয় প্রবাসে যাওয়ার আশায় স্বপ্ন বোনা শ্রমিকদের।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। সেই সময় ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানো যেতো। এরপর ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বরে নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খুলতে সময় লেগেছিল ৩ বছর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। তখন প্রথমে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হলেও পরে তা বাড়িয়ে ১০১টি করা হয়। ২০২৪ সালের ৩১ মে থেকে আবারও কর্মী নেওয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি।  

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও সুরাহা হয়নি এই সিন্ডিকেট ইস্যুর। এই সমস্যার সমাধান চাইতেই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সদস্যরা।  

অভিবাসন সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মালয়েশিয়া থেকে  যে রেমিট্যান্স আসে তার চেয়ে বেশি টাকা পাচার করে সিন্ডিকেট। এ পরিস্থিতিতে শ্রম চুক্তির কয়েকটি ধারা সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রম অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যান্ডি হল এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন, কর্মী নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা যাতে সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি পায় সেজন্য দু-দেশের মধ্যকার শ্রমচুক্তি সংশোধন করার পরামর্শ দেন তিনি। দায়িত্বজ্ঞানহীন, অনিয়মিত ও অনৈতিক নিয়োগ এবং এ ধরনের আচরণের জন্য অসদাচরণ, ঋণের দাসত্ব ও অন্যান্য নির্যাতনের ফলে অনেক শ্রমিকের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে বলেও দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি ।

এদিকে হাসিনা সরকারের আমলে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারের নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের অবৈধ অর্থ লোপাটের বিচার ও  ফের মালয়েশিয়া শ্রমবাজার দ্রুত উন্মুক্তের দাবি জানান (বায়রা) সদস্যরা। শ্রমিকদের বিদেশ যেতে সরকার ৮০ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে জনপ্রতি সাড়ে ৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। যেখানে ৫০ জনের কাজের জায়গা রয়েছে, সেখানে ৫০০ লোক নিয়েছে। ফলে সেখানে গিয়ে শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বলে জানান বায়রার সদস্য খন্দকার আবু আশফাক। আবারও সিন্ডিকেট করা হচ্ছে এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, এবার কোনোভাবেই সিন্ডিকেট হতে দেওয়া হবে না, প্রতিরোধ করা হবে। বিএনপির কেউ সিন্ডিকেটে বিশ্বাসী নয়। যদি কেউ সিন্ডিকেটে যায়, ব্যক্তি হিসেবে যাবে, দল হিসেবে নয়। মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে কোনো প্রকার অসাধু চক্রের ফাঁদ যাতে আর তৈরি না হয় সে বিষয়ে জোর দাবি জানান বায়রার সদস্যরা।  

প্রবাসে শ্রমবাজার কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং সব বৈধ এজেন্সির জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে ও কম খরচে কর্মী পাঠানো নিশ্চিত করতে তারা স্মারকলিপিতে দাবি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং নেপালের অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা এখনও অন্যান্য উৎস দেশগুলোর পাশাপাশি আপডেট হওয়া এফসিডাব্লুএমএস ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বায়রার সদস্যরা অভিযোগ তুলেছেন, সিন্ডিকেটের শর্ত মেনে নেওয়ার জন্য চলমান আলোচনা এই দেশগুলোর জন্য অংশগ্রহণকারীদের তালিকাভুক্ত করতে বিলম্ব করেছে।

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার তথ্য এসেছে ‘একটি উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ নামের শ্বেতপত্রে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গত বছর দেশের অর্থনীতি নিয়ে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে, সেখানে এটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠিয়ে ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির চক্র দেড় বছরেই হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। প্রায় পৌনে ৫ লাখ কর্মীর কাছ থেকে অতিরিক্ত এই অর্থ নিয়ে নিজেদের পকেটে ভরেছে চক্রটি। চাহিদার বেশি কর্মী পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের চার সংসদ সদস্যের নামও এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এরই মধ্যে সাবেক চার এমপির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তারা হলেন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি আ হ ম মুস্তফা কামাল, নিজাম উদ্দিন হাজারী, বেনজীর আহমেদ এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। প্রথম তিনজন আওয়ামী লীগের এবং মাসুদ উদ্দিন জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। মালয়েশিয়া সরকার ২০২২ সালের জুনে ২৫ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেয়। এসব এজেন্সি সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পায়। এতে চার বাংলাদেশি মন্ত্রী ও এমপির প্রতিষ্ঠান ছিল।

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয় নাগরিক আমিনুল ইসলাম আবদুন নুর। বাংলাদেশ অংশের নিয়ন্ত্রণ করতেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপন।  বাংলাদেশ সরকার প্রত্যেক কর্মীর অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করেছিল ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের বাংলাদেশ অংশের নিয়ন্ত্রকরা ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা করে নেন। মালয়েশিয়ার নিয়ন্ত্রকরা ভিসাপ্রতি ছয় হাজার রিঙ্গিতের সমপরিমাণ প্রায় দেড় লাখ টাকা নেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়েছেন রুহুল আমিন স্বপন। তবে দুই হোতাকে দেশে ফিরিয়ে আইনের আওতায় আনতে গত ২৪ অক্টোবর ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এদিকে সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিতের জোর দাবি জানিয়েছে বায়রা। পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের বিতর্কিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত অনলাইন সফটওয়্যার বাতিল করার জন্য মালয়েশিয়া সরকারের কাছে দাবি জানাতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার কাছে জোর দাবি তুলে ধরা হয়।

ভোগান্তি কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও সরকারিভাবে খুব বেশি মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গেছেন মাত্র ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ মানুষ। আর দালালের বাইরে বেসরকারি কোম্পানি বা এজেন্সিগুলোকে টাকা দিয়ে বিদেশে গেছে ৪২ দশমিক ০৯ শতাংশ। অন্যান্যভাবে বিদেশ গেছে ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসনের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সমস্যা। শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের সম্পৃক্ততা দরিদ্র কর্মীদের খরচ বাড়িয়ে দেয়।  

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ মানুষ বিদেশ যেতে ঋণের ওপর নির্ভর করেন। শহরের ৫১ দশমিক ৮৩ শতাংশ ও গ্রামের ৬০ দশমিক ০৭ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছেন। নারীদের (৩৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ) তুলনায় পুরুষরা (৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ) বেশি ঋণ নেন। এদিকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পাশাপাশি স্থায়ীভাবে ফেরতও আসছেন অনেকে। মালয়েশিয়া থেকে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ দেশে ফেরত এসেছেন বলে বিবিএসের তথ্যে জানা গেছে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।