গাজীপুর মহানগর চৌরাস্তা এলাকায় গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে দৈনিক প্রতিদিনের গাজীপুর স্টাফ রিপোর্টার মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮) জনসমক্ষে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একইদিন তার বন্ধু, দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভকে (৩২) মারধর করে ইট দিয়ে পা থেঁতলে দেওয়া হয়।
তুহিন হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ ও প্রশাসনের অপারগতা নিয়ে কথা হচ্ছে। গাজীপুর মহানগরের মেট্রোপলিটন সদর থানার পাশে সৌরভকে মারধরের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি নিয়ে সমালোচনা চলছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় এমন প্রকাশ্য নৃশংসতা সমাজে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ও অনিরাপত্তার ইঙ্গিত দেয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। একই সঙ্গে প্রকাশ্যে মানুষকে পিটিয়ে, কুপিয়ে আহত করার ঘটনাও বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো জানান দেয়, প্রশাসনের দুর্বলতা ও নজরহীনতার কারণে সমাজে এর প্রভাব বেড়েছে। ফলে খুব সাবলীলভাবে দুর্বৃত্তরা মব সৃষ্টি করতে পারছে। এছাড়া সামাজিক অবক্ষয় এমন পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা
লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পাথর মেরে হত্যা, সাংবাদিক তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা, সৌরভের পা থেঁতলে দেওয়াসহ গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি নৃশংসতা হয়েছে। সৌরভ বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।
তুহিনের হত্যার ঘটনায় আসামিদের শনাক্ত করার পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ক্রাইম-উত্তর) রবিউল হাসান ও বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, সৌরভের ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে।
যা হয়েছিল সৌরভ ও তুহিনের সঙ্গে
৭ আগস্ট গাজীপুর মহানগরের মেট্রোপলিটন সদর থানার পাশে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভকে মারধর করা হয়। কয়েকজন দুর্বৃত্ত তাকে হাত ধরে টেনে মাটিতে ফেলে মারধর করে। তাদের মধ্যে একজন ইট দিয়ে বারবার আঘাত করে সৌরভের পা থেঁতলে দেয়। চাঁদাবাজির ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সৌরভকে এ হামলার শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশের সক্রিয়তার ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
একই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে পাঁচ-ছয়জন দুর্বৃত্ত। এ সময় তিনি দৌড়ে ঈদগাঁ মার্কেটের একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নেন। পরে দুর্বৃত্তরা তাকে দোকানের ভেতরে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
খায়রুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি ঘটনার সময় দুর্বৃত্তদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সে সময় তিনি ওই দোকানেই বসে ছিলেন। দোকানের বাইরে দুই দুর্বৃত্ত রামদা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনজন দোকানের ভেতর ঢুকে তুহিনের ওপর হামলা চালায়। খায়রুল তাদের বাধা দেওয়ার সময় তাকেও কুপিয়ে হত্যার হুমকি দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে ঘটনাটি দেখছিলেন, কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে আসেননি।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ বলছে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা সাংবাদিক মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার আগে তারা আরেক ব্যক্তিকে অস্ত্র দিয়ে ধাওয়া করে। সেটি দেখে নিজের মুঠোফোনে দৃশ্যধারণ করছিলেন তুহিন। ঘটনাস্থলের একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে এ দৃশ্য দেখা গেছে।
এ দুই ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর থেকে এক ব্যক্তির মাথাবিহীন ৮ খণ্ড লাশ মেলে। স্থানীয় একটি দোকানের পাশে পড়ে থাকা ট্রাভেল ব্যাগ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয় বলে জানান টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফরিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে এক দোকানের সামনে একটি ট্রাভেল ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা। ব্যাগের পাশে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো লোকজন না দেখে তাদের সন্দেহ হয়। পরে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই ব্যাগটি খোলে। সেটিতে এক ব্যক্তির মাথাবিহীন দেহের আটটি খণ্ড পাওয়া যায়। দুই-তিনদিন আগে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অ্যাডিশনাল কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদুল হাসান বলেন, সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্বামী স্ত্রীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপরাধীদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের ভিডিও করার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হলেও অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া অপর এক সাংবাদিককে ইট দিয়ে পা থেঁতলে দেওয়ার বিষয়গুলো তদন্ত করছে পুলিশ। পাশাপাশি গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর থেকে যার লাশের আটটি খণ্ড উদ্ধার হয়েছে তার নাম অলি। এই বিষয়ে তদন্ত চলছে।
দুদিন আগে গত ৬ আগস্ট রাজধানী বংশাল মালিটোলা এলাকায় হীরা নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনার পেছনে মাদক বেচাকেনা ও সেবনের বিষয় থাকতে পারে। হত্যার ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
তার আগে গত ৩ আগস্ট দিবাগত রাতে রাজধানীর দারুস সালাম থানার দক্ষিণ বিশিল এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে তাহমিনা রহমান রানু (৪২) নামে এক নারী নিহত হন। তিনি স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামের বোন।
দারুস সালাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেবব্রত কুমার বিশ্বাস জানান, রানুর একটি দোকান রয়েছে। তিনি সেটি ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন। ওইদিন রাতে দুর্বৃত্তরা তার ভাইয়ের খোঁজে এসেছিল। কিন্তু আমিনুলনে না পাওয়ায় তারা তাহমিনাকে কাছ থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠন যা বলছে
মব তৈরি করে হত্যাসহ সংশ্লিষ্ট অপরাধের ঘটনায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, যেকোনো আলোচিত অপরাধ হওয়ার ঘটনার ২৪ ঘণ্টা বা কয়েক দিনের মধ্যেই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হচ্ছে পুলিশ। কিন্তু অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই কীভাবে সেটিকে রুখে দেওয়া যায়, সেটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অপরাধ হওয়ার পর যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধী ধরার তৎপরতা বেড়ে যায়; সেভাবেই অপরাধ হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া দরকার। এমনও দেখা গেছে, একটি জায়গায় ঘণ্টাব্যাপী ঘটনা ঘটছে, কিন্তু পুলিশের পৌঁছতে দেরি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দ্রুত স্পটে গিয়ে এর প্রতিরোধ করতে হবে কঠোরভাবে। এছাড়া সরকারের তরফ থেকে উন্মুক্তভাবে পুলিশকে কাজ করতে দিতে হবে। পাশাপাশি অপরাধীদের অপরাধ কার্যক্রম প্রতিরোধে জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। যত অভিযোগ, যত মামলা, যত অপরাধ থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তিকে সবার সামনে কুপিয়ে বা পিটিয়ে হত্যা করা অপরাধ।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, এসব ঘটনা শুধু মানবজীবনের করুণ পরিণতি নয়, এটি দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হামলা। এটি প্রমাণ করে, দেশে সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের দুঃসাহস কতটা বেড়ে গেছে এবং তারা আইন ও প্রশাসনের ভয় না করে প্রকাশ্যে অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত হচ্ছে।
তাদের হিসাব অনুসারে, চলিত বছরের সাত মাসে (জানুয়ারি থেকে জুলাই) কমপক্ষে ১৬৯টি হামলার ঘটনায় ২৮৪ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সকল ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ১২৬ জন, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ২৫ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৩৯ জন। ১০ সাংবাদিক গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ২৪টি মামলায় ৯৪ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার কোনো না কোনো জায়গায়, অথবা দেশের কোথাও না কোথাও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি মধ্যযুগীয় কায়দায় কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করার সংবাদও আমরা দেখছি। প্রকাশ্য রাস্তায়, দিনের আলোয়, জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় এমন নৃশংস ঘটনা ঘটছে যা আমাদের সমাজে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চরম স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। এতে শুধু নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে না, বরং পুরো সমাজজুড়ে এক ধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, মব সৃষ্টি করে একজন সাংবাদিককে হত্যা করা কেবল একটি অপরাধ নয়— এটি দেশের আইনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও মানবাধিকারের ওপর একটি সরাসরি আঘাত। এর প্রতিক্রিয়া শুধু সাংবাদিক মহলেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোকে নাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও জনগণের কঠোর প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ জরুরি।
এজেডএস/এমজে