স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) চত্বরে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যার দুদিন আগে খুনিদের সঙ্গে তার মারামারির ঘটনা ঘটেছিল। এরপরই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
জানা গেছে, গত ৭ জুলাই সোহাগের সঙ্গে তার দোকানে হত্যাকাণ্ডে জড়িত মাহমুদুল হাসান মহিনের বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। এই বিষয়ে জানতে সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগও করে বংশাল থানা পুলিশ। তবে তখন সোহাগ ঝামেলা মিটে গেছে বলে পুলিশকে জানায়।
সূত্র আরও জানায়, সোহাগ ও মাহিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। দুইজন একসঙ্গে ব্যবসা করতেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য মাহিনকে টাকাও দিতেন সোহাগ। মাসখানেক আগে সোহাগের কাছে দুই লাখ টাকা করে নির্ধারিত মাসোয়ারা চায় মাহিন। সোহাগ তা দিতে অস্বীকৃতি জানালে দুই বন্ধুর মধ্যে শুরু হয় শত্রুতা। এই টাকা চাওয়া নিয়েই হত্যাকাণ্ডের দুদিন আগে তাদের মধ্যে মারামারি হয়। ওইদিনই টিটন গাজীকে সঙ্গে নিয়ে সোহাগকে হত্যার পরিকল্পনা করে মাহিন।
এই বিষয়ে জানতে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল হাসান জানান, তিনি এই বিষয়ে অবগত নন।
তবে কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান মনির বলেন, সোহাগের দোকানটি আমাদের থানা এলাকায় না। এটা বংশাল থানা এলাকায়। পরে আমরা এই হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে তাদের মধ্যে দুদিন আগে মারামারির তথ্য পেয়েছি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সোহাগ হত্যায় ১৯ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। এর মধ্যে ১১ জনকে শনাক্ত করতে পেরেছে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। যার মধ্যে ৭ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। বাকিরা বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন বিকালে সোহাগ দোকানে আসার কয়েক মিনিট পরই হত্যাকারীরা সাতটি মোটরসাইকেলে করে এসে তাকে মারতে মারতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে নিয়ে যায়। এরপর হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে ইট-বালু-সিমেন্টের তৈরি পাথরসদৃশ কংক্রিট দিয়ে বারবার বুকে ও মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর তাকে গেট দিয়ে বের করে রাস্তার ওপর নিয়ে আসা হয়। সেখানেই তার বুকের ওপর লাফিয়ে বুনো উল্লাসে মেতে ওঠে খুনিরা। এই ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, প্রথমে সোহাগকে তার দোকানেই হত্যার পরিকল্পনা করে খুনিরা। এজন্য অস্ত্রও সংগ্রহ করা হয় ছোট মনিরের মাধ্যমে। পরে ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে ‘মব’ সৃষ্টির পরিকল্পনা করে তারা। এজন্য সোহাগকে দোকান থেকে টেনে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে জনসম্মুখে নিয়ে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি বুনো উল্লাসও করা হয়। যাতে এই হত্যাকাণ্ডকে মব সাজিয়ে পার পেতে পারে খুনিরা। এছাড়া এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদেরও কড়া বার্তা দিতে চেয়েছিল হত্যাকারীরা।
সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের মিটফোর্ড সড়ক ধরে চকবাজারের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই ডান পাশে রজনী বোস লেন। ভাঙারি দোকান দিয়ে ভরা সেই লেনে ঢুকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই ডান পাশে চোখে পড়বে ‘সোহানা মেটাল’ নামে সাইনবোর্ড সাঁটানো দোকান। এই দোকানটিই কয়েক মাস আগে ভাড়া নিয়ে ভাঙারি ব্যবসা শুরু করেন সোহাগ। গত ৯ জুলাই বিকালে ওই দোকান থেকেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এরপর থেকে বন্ধই রয়েছে সোহানা মেটাল।
ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার পর থেকে সেখানকার ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন। গত রোববার (১৩ জুলাই) রজনী বোস লেনে গিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও আতঙ্কে কেউ এই বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ওই সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল দেখছেন। গেটের ভিতরে পড়ে থাকা ইট-বালু-সিমেন্টের তৈরি পাথর সদৃশ দুটি কংক্রিট ঘিরে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। আগতদের কেউ কেউ সেই কংক্রিটকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পাথর বলে মনে করছেন। তবে পুলিশের ভাষ্যমতে, পড়ে থাকা ওই কংক্রিটটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পাথরটি আলামত হিসেব পুলিশ নিয়ে গেছে। পড়ে থাকা কংক্রিটটি অন্য জায়গা থেকে কেউ এনে রেখেছে।
ঘটনাস্থলের আশপাশের ব্যবসায়ী ও রিকশা চালকরা জানান, ঘটনার পর থেকে দলে দলে মানুষ ওই বস্তুটিকে দেখতে আসছে। গত শনিবার ভিড় এত বেশি ছিল, মনে হয়েছিল সেখানে কোনো সভা বা সমাবেশ চলছে।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান মনির বলেন, আমরা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পাথরটি আলামত হিসেবে নিয়ে এসেছি। সেখানে পড়ে থাকা পাথরটি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়নি। কেউ পরে হয়তো ওই ধরনের কোনো পাথর রেখেছে।
ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যায় এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেপ্তাররা হলেন- এজাহারভুক্ত আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১), তারেক রহমান রবিনকে (২২), আলমগীর (২৮), মনির ওরফে লম্বা মনির (২৫), মো. টিটন গাজী (৩২), সজীব ব্যাপারী (২৭) ও মো. রাজিব ব্যাপারী (২৫)। এরমধ্যে তিনজনকে কোতোয়ালি থানা পুলিশ, দুজনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও দুইজনকে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে তারেক রহমান রবিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সোহাগ হত্যার ঘটনায় দুইটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলা ও একটি অস্ত্র আইনের মামলা। এই ঘটনায় জড়িত ৭ জন গ্রেপ্তার হলেও অধরা রয়েছেন ১২ জন। এজাহারভুক্ত সেই ১২ আসামি হলেন- সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, মো. নান্নু, রিয়াদ, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজম আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, আনোয়ারুল হক রনি, কাইয়ুম মোল্লা, রাকেশ ও রহিম।
জানা গেছে, ডিএমপির পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাব এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে। পুলিশের পাশাপাশি তারাও পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
এসসি/এমজে