ঢাকা: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে কি না- এই প্রশ্নে ফের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর এবং দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই সংশয় তৈরি হয়েছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল এখনো সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বলে মত বিশ্লেষকদের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক, যা রাজনৈতিক সমীকরণে জটিলতা সৃষ্টি করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আদৌ নির্বাচন করা সম্ভব কি না, এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এমন প্রশ্ন উত্থাপনের বিষয়টি এখন আর বিচ্ছিন্ন বক্তব্য হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছে কোনো কোনো মহল।
শনিবার (১৯ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন (কেআইবি) মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য দিতে গিয়ে তারেক রহমান সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কেউ সময়ক্ষেপণ করতে চাইছে কি না, এ ব্যাপারে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ’
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত কিছু নৃশংস ও অনাহূত ঘটনা জনমনে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতাকে কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো একটি অংশের সহায়তায় কেউ কেউ দেশে উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে কি না, এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় মানুষের কথা শুনলে বোঝা যায়, এ বিষয়ে জনমনে জিজ্ঞাসা রয়েছে। ’
এদিকে জাতীয় নির্বাচন কী পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে- তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টনের (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের দাবির পর এ বিষয়ে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না বলেই তারা পিআর পদ্ধতি চাচ্ছেন।
শনিবার (১৯ জুলাই) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশ করে ইতোমধ্যেই দলের শক্তি প্রদর্শন করেছে জামায়াতে ইসলামী। এই সমাবেশ থেকে তারা আবারও বার্তা দিয়েছে- নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার করতে হবে। নির্বাচন হতে হবে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (পিআর) পদ্ধতিতেই।
দেশের বৃহত্তম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, এ ধরনের পদ্ধতি প্রচলিত রাজনৈতিক ভারসাম্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এর পেছনে নির্বাচনের সময়সূচি বিলম্বিত করার কৌশলও লুকিয়ে থাকতে পারে।
পিআর পদ্ধতির পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া উভয় পক্ষই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিজেদের অবস্থানের সঙ্গে সংহতি জানাতে উদ্বুদ্ধ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিআর পদ্ধতির পক্ষে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একমতে থাকা সকল রাজনৈতিক দলকেই শনিবারের সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
তবে জামায়াতের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি এবং প্রাক্তন শিবির সভাপতির নেতৃত্বে গড়া এবি পার্টিকে এই সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এ বিষয়ে শনিবার (১৯ জুলাই) সাংবাদিকদের প্রশ্নে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, শুধুমাত্র পিআর পদ্ধতির পক্ষে থাকা দলগুলোকেই তাদের সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
একইদিনে বনানীর হোটেল অমনি রেসিডেন্সিতে ‘জুলাই অভ্যুত্থান ও রাজনীতিতে গুজব’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা সভায় যোগ দেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে বিএনপির অনুপস্থিত থাকার প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বলেন, ‘দাওয়াত দেয়নি, যাবো কীভাবে?’ এ সময় তিনি আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিএনপি যেত কি না সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ‘দাওয়াত দিলেও যে যেতাম বিষয়টি তেমন না। ’
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে বৃহৎ দুটি দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থান শেষ পর্যন্ত সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগিসহ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সরকার কিংবা অন্য কারো ওপর চাপ তৈরির জন্যই ‘পিআর পদ্ধতিতে’ নির্বাচনের দাবিটি সামনে আনা হয়ে থাকতে পারে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এই দূরত্ব না ঘুচলে, আসন্ন নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দ্রুত নির্বাচনের দাবি ছিল বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের। দেশ দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে থাকা অগণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছিল। দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিএনপি বারবারই মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়।
অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা শিক্ষার্থীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামী সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। নির্বাচন নিয়েও তাদের তেমন তাড়া ছিল না। তারা বরাবরই নির্বাচনের আগে সংস্কার শেষ করার তাগিদ দিয়ে এসেছে।
বিএনপি এবং এর সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সে সময় থেকেই অদৃশ্য দ্বন্দ্ব তৈরি হয় জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির। এই দ্বন্দ্ব তীব্র হয় ৬ জুন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিলে। বিএনপির দাবি ছিল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছিল, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন হলে তাদের আপত্তি নেই। প্রধান উপদেষ্টার এপ্রিলে নির্বাচনের সময় নির্ধারণকে তাই জামায়াতের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে আশঙ্কা করছিলেন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর নেতৃবৃন্দ।
তবে ১৩ জুন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিকে নির্বাচনের সময় হিসেবে যৌথ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলোর নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছিলেন। যদিও ওই যৌথ ঘোষণায় সরকার পক্ষ থেকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল- সংস্কার ও গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলে রোজার আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।
লন্ডনের বৈঠকের পর বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে সংকট কেটে গেছে এবং আগামী বছর রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। এর ফলে তারা নির্বাচনমুখী তৎপরতাও শুরু করেন। যদিও লন্ডন বৈঠক থেকে ‘একটি দলের নেতার সঙ্গে সরকার প্রধানের যৌথ ঘোষণা’ নিয়ে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু লন্ডন বৈঠকের ঘোষণার প্রভাবে ওই দলগুলোর মধ্যেও ধারণা তৈরি হয়েছিল যে রোজার আগেই নির্বাচন হতে পারে।
সে সম্ভাবনা মাথায় রেখেই দলগুলো নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করে। রাজনীতিতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে নানা মাত্রার মেরুকরণ। তবে এত কিছুর পরও প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল- সত্যিই কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? শুধু তাই নয়, আদৌ নির্বাচন হবে কি না, সে নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্দেহ-সংশয়ের আলোচনা অব্যাহত থেকেই গিয়েছিল। সম্প্রতি তারেক রহমানের নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশে রাজনৈতিক মহলে এই প্রশ্নগুলো নতুন করে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাংলানিউজকে বলেন, ‘নির্বাচনের ডেটটা কবে হবে, এই ব্যাপারে তো সরকার কোনো নির্দিষ্ট কথা বলছে না। তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সেটা না হয় কিছুদিন পরে করবে। কিন্তু কোন তারিখে নির্বাচন হবে, এটা তো সরকার বলতে পারে। এটা তাদের মূল দায়িত্ব। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যেই তারা আলাপ-আলোচনা করেছে। অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে, রমজানের আগেই নির্বাচনটা হওয়া উচিত। লন্ডনে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি আসার পর গোটা দেশবাসী আশ্বস্ত হলো, আমরা এখনো আশা রাখছি। কিন্তু রমজানের আগে নির্বাচন হওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখছি না। সেক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সংশয়কে যথার্থই মনে করি। নির্বাচন নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার অভাব দেখছি। ’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন আয়োজনে অপারগতা প্রকাশ করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি উঠবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘এটা দল আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এখন রাজনৈতিক গতিশীলতার যে জায়গাটা এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে যে সরকার আছে, তাদেরকেই আমরা মনে করছি নিরপেক্ষ সরকারের দায়িত্ব পালন করবে এবং কোন মাসে নির্বাচন হবে, সেটাও দ্রুত বলবে। দ্রুততম সময়ে সরকার সময় ঘোষণা করার পর নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে- এটাই জনপ্রত্যাশা। এর বাইরে সরকারের কোনো মাস্টারপ্ল্যান আছে কি না, এটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। আমি বলতে পারছি না। ’
যদিও শনিবার (১৯ জুলাই) কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) ময়নামতি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘টেডএক্স কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া সময়সূচি অনুযায়ী যথাসময়েই নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। নির্বাচন পেছানোর কোনো পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।
তবে কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ নির্বাচন নিয়ে সরকারের সদিচ্ছার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছেন না বলেও জানিয়েছেন। সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড, গোপালগঞ্জে এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সমর্থকদের হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন করে রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। এরই মধ্যে কক্সবাজারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদকে ইঙ্গিত করে এনসিপির একজন নেতার ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ বক্তব্য ঘিরে বিএনপি সমর্থকদের মঞ্চ ভাঙচুরের ঘটনা সেই উত্তেজনায় ঘি ঢেলে দেয়।
এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সংশয় ঘনীভূত হচ্ছে- আসন্ন নির্বাচন আদৌ হবে কি? আবার কেউ কেউ এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন, পরিকল্পিতভাবে দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে কোনো একটি গোষ্ঠী নির্বাচন পেছানোর কৌশলী ছক কষছে।
রাজধানীর মাইলস্টোন কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় শিশু শিক্ষার্থীসহ ৩১ জন নিহত হওয়ার পরদিনই ২২ জুলাই সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের ঘেরাও কর্মসূচি এই কৌশলের অংশ কি না সেটাও অনেককে ভাবিয়েছে।
সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন বসলে যে কোনো সংকট এড়ানো যেত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বুধবার (২৩ জুলাই) সকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের কাছে এ কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যের কোনো ঘাটতি নেই এবং এ ঐক্য অটুট রয়েছে। গতকাল রাতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আমরা অংশ নিয়েছিলাম, কারণ সরকার কোনো সংকটে পড়লেই আমাদের ডাকে। আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাই সে আলোচনা থেকে পিছিয়ে আসিনি। মতবিনিময় আরও ঘন ঘন হলে অনেক সংকট এড়ানো যেত। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে কি না, এটা নিয়ে সবার মধ্যেই সংশয় আছে। গোপালগঞ্জের ঘটনা, কক্সবাজারের ঘটনা, আবার দেখলাম শেখ হাসিনা এক ভিডিওতে বলেছে, এমন ঘটনা আরও ঘটাবে, ৩০ জায়গায় নাকি তারা সংগঠিত হয়েছে- এসব ঘটনা তো আশঙ্কাজনক। সে হিসেবে তারেক রহমান যে সংশয় প্রকাশ করেছেন, সেটা ভিত্তিহীন নয়। ’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তেমন কার্যকর ভূমিকায় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদস্যরা বেশ দুর্বল হয়ে আছেন। ৫ আগস্টের ঘটনার পর তারা সুসংগঠিত হয়েছেন, এমনও মনে হচ্ছে না। তাদের প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দিতেও দেখছি না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে শক্তভাবে নজর না দিলে নির্বাচন সঠিকভাবে হবে কি না, সেটাও আশঙ্কার বিষয়। নির্বাচনের আগে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তিশালী করা উচিত। ’
যশোর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাংবাদিক নেতা ফকির শওকত বাংলানিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচন বিরোধী শক্তি নানা ধরনের তৎপরতা চালাতে ব্যস্ত আছে। দীর্ঘদিন মানুষ ভোটাধিকার বঞ্চিত ছিল, নিজেদের অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত ছিল, সে কারণেই গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। চাকরির কোটার জন্য গণঅভ্যুত্থান ঘটেনি। সেই ভোটাধিকার যদি নানা কারণে এখনো আটকে রাখা হয়, তবে বুঝতে হবে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। সেখান থেকে সংশয় তো একটা আছেই। ’
নির্বাচন যদি বিলম্বিত হওয়ার মতো অবস্থা দেখা দেয় তবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি পুনরায় সামনে আসতে পারে বলে মনে করছেন এই সাংবাদিক নেতা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের যদি কোনো অপারগতা থেকে থাকে, আইনগতভাবে উচিত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। ’
২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। ১৩ বছর পর গত ১৭ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। চলতি বছর ৮ জুলাই এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট।
এদিকে রোববার (২০ জুলাই) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের শুরুতে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়ে একটি সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। এ প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে।
যদি দেশের সাম্প্রতিক চলমান অস্থিরতা আরও ঘনীভূত হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পেছাতে হয়, তবে নির্বাচনকালীন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হবে কি না- এই প্রশ্নও জোরালো হয়ে উঠছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আলোচনায়।
তবে রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। রোববার (২০ জুলাই) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ঢাকা ও তৎসংলগ্ন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোর কমিটির বৈঠক ও বিশেষ সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে না, এমন কথা ঠিক নয়। আমাদের হাতে এখনো সময় আছে। প্রস্তুতি চলছে, প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কোনো অসুবিধা হবে না। ’
নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মাঠে উত্তাপ বাড়ছে, কিন্তু নির্বাচন নিয়ে নিশ্চয়তা এখনো থেকে যাচ্ছে অধরা। সহিংসতা, কৌশল আর সংশয়ের আবহে প্রশ্ন একটাই- গণতন্ত্রের যাত্রা কি সামনের দিকে এগোবে, নাকি আবারও অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেবে রাজনৈতিক বাস্তবতা?
এসবিডব্লিউ/এজে