ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

জাল কাঁধে লবণাক্ততার সঙ্গে লড়ছেন উপকূলের নারী জেলেরা

পিংকি আক্তার, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে ফিরে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:১৩, আগস্ট ৭, ২০২৫
জাল কাঁধে লবণাক্ততার সঙ্গে লড়ছেন উপকূলের নারী জেলেরা গীতা মুন্ডা ও রানী মুন্ডা

শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে এক হাতে বৈঠা আর এক হাতে জাল নিয়ে খালি পায়ে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করলেন শ্যামনগর দাতিনাখালি গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী গীতা মুন্ডা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাছ ধরবেন।

উঠে পড়লেন নৌকায়। তার সঙ্গী হয়েছেন তার ভাবী রানী মুন্ডা।

গ্রামটির অধিকাংশ নারীই মাছ ধরা পেশার সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে নদীতে পোনা মাছ ধরে তারা পরিবারের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করেন।

খুব ভোরে, সূর্য ওঠার আগেই জাল কাঁধে নদীতে নামেন তারা। কোমরসমান লবণাক্ত পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মাছ ধরেন। ঘন বনে কাঁকড়াও ধরতে যান এই নারীরা। কোনো কোনো দিন জালভর্তি করে তাদের আঁচলে উঠে আসে অনেক রকমের মাছ। আবার কোনো দিন ৪০টা পোনা পেতেও নদীতে শরীর ভিজিয়ে থাকতে হয় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা।

‘আগে একবার জাল ফেললেই কত রকম মাছ যে উঠতো, আর এখন পুরো দিনে আধা কেজি জোটে কি না সন্দেহ,’ বলেন ৪৫ বছর বয়সী গীতা মুন্ডা। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরছেন।  

‘নদী আর আগের মতো নাই। আর মাছও নাই,’ বলেন তিনি।

তার হাতে ঘা দেখিয়ে বলেন, ‘ছোটবেলা আমাদের বিয়ে করে নিয়ে আসছে। তখন থেকে স্বামীর সাথে মাছ ধরার কাজ করছি। আগে মিঠা পানি ছিল আর এখন লবণ পানিতে আমাদের শরীরে ঘা হয়ে যাচ্ছে। আর মিঠা পানিতে যেই মাছ টিকে, সেই মাছতো লবণ পানিতে থাকে না। তাই মাছও কমে যাচ্ছে। আগের মতো নানা রকম মাছ এখন আর দেখি না। খালি চিংড়ি, ফাইসসা, টেংরা এসব মাছ। ’

গীতার মতো আরও অনেক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লবণাক্ত পানিতে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কাজ করতে গিয়ে নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন পায়ের পচন, চর্মরোগ ও জরায়ু সংক্রান্ত জটিলতায়।

‘আমার জরায়ু কেটে ফেলতে হইছে,’ বলেন গীতা মুন্ডা। ‘ডাক্তার কইছে, এই পানিতে আর কাজ করলে শরীর নষ্ট হইয়া যাবে। ”

গত ৪ মাস আগে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিজের জরায়ু অপসারণ করান গীতা। ‘হঠাৎ করে পেটের মধ্য ব্যথা আর মাসিক হচ্ছিল না। পরে ডাক্তার দেখালে বলে টিউমার। পরে সেইটা অপরাশেন করে ফেলতে হইছে, টিউমারের ওজন ছিল আড়াই কেজি।

প্রকৃতির সঙ্গে রূপ বদলেছে লড়াইয়ের 
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের একটি। ঘূর্ণিঝড় আইলা (২০০৯), ফণী (২০১৯), আম্পান (২০২০), সিত্রাং (২০২২) একের পর এক দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এখানকার নদীবাঁধ, চিংড়ি ঘের, কৃষিজমি, আর মানুষের জীবন। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে সরাসরি প্রভাব পড়েছে পানির লবণাক্ততায়। সারা বছর নদীর পানি এখন লবণাক্ত হয়ে আছে, এমনকি খাওয়ার পানিও আজ দুর্লভ।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় প্রতি দুইজন নারীর একজন জরায়ু, ডিম্বাশয় বা প্রজনন অঙ্গ-সম্পর্কিত জটিলতায় ভুগছেন। সিপিআরডির ২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ত পানি, ঘূর্ণিঝড় ও খাদ্য সংকটের কারণে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৫৪ শতাংশ নারী এসব সমস্যায় ভুগছেন, যা জলবায়ু ন্যায়ের চরম লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় নারীরা যারা নিয়মিত লবণাক্ত পানিতে কাজ করেন, তাদের ৬৭ শতাংশ বিভিন্ন ত্বক ও গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যায় আক্রান্ত হন।

তবে এসব গবেষণা মূলত শহরে প্রকাশ হয়, স্থানীয় প্রশাসন বা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে না। ফলে এই নারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে নিছক পরিসংখ্যান, বলছেন পরিবেশবিদরা।

নারীরা কেবল ‘সহযোগী’ নয়, তারাও নেতৃত্বে
সাধারণত মাছ ধরা বা জেলে পেশাটি পুরুষদের কাজ হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু শ্যামনগরের বাস্তবতা আলাদা। এখানে নারীরাও মাছ ধরেন, জাল তৈরি করেন, ঘের দেখাশোনা করেন, এমনকি বাজারজাত করতেও যান। অনেক পরিবারেই পুরুষেরা কাজের সন্ধানে বাইরে থাকেন, আর নারীরাই পরিবারের অর্থনীতির দায়িত্ব কাঁধে নেন।

৪০ বছর বয়সী আমেনা খাতুন বলেন, ‘স্বামী ঢাকায় কাজ করে, আমি মাছ ধরেই বাচ্চাদের পড়াশোনা চালাই। ’ আর এই মাছ ধরতে তাকে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিতে হয়েছিল। তাই মহাজনের কাছেই বাজারের চেয়ে কম দামে বাধ্য হয়ে মাছ বিক্রি করতে হয় আমেনাকে।

শত শত নারী জেলে দাদন নিয়ে মাছ ধরেন। কিন্তু এ দাদনই তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। কারণ তারা যে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেন, বাধ্যতামূলকভাবে তার কাছেই মাছ বেচতে হয়। এতে একদিকে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন, অন্যদিকে দেনার বোঝা আরও চেপে বসে।

তবে স্থানীয়ভাবে তাদের এই শ্রম বা নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এখনো সরকারি প্রকল্প, প্রশিক্ষণ কিংবা জলবায়ু তহবিলের আওতায় নারীদের অংশগ্রহণ খুব সীমিত। তারা উন্নয়নের ডাটাবেসে নেই।  

সরকারি হিসেবে শ্যামনগর উপজেলায় ১৬ হাজার ৮শ ৫৮ জন কার্ডধারী জেলের মধ্য নারী কার্ডধারী জেলের সংখ্যা ৭ হাজার ৭৩ জন। তবে এই সংখ্যা যে আরও বেশি সেটি এলাকা ঘুরেই প্রত্যক্ষ করা গেছে।  

এখানে ৫৮ দিন সমুদ্রে মাছ ধরা নিষেধ। আর এই ৫৮ দিন শুধু সমুদ্রগামী নিবন্ধিত জেলেদের প্রতিমাসে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়, যা এই ৫৮ দিনে ৭০ থেকে ৭৫ কেজির মতো হয় বলে জানান শ্যামনগর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মোহাম্মদ তৌহিদ হাসান। এখানে নারী জেলেদের জন্য আলাদা করে কোনো প্রণোদনা নেই, বলেন তিনি।  

বিকল্প পেশা ও রূপান্তরের সম্ভাবনা
উপকূলে কিছু এনজিও ও নারী সংগঠন নারীদের বিকল্প জীবিকা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যেমন- শুকনো মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, চাষাবাদে নার্সারি তৈরি, বেতশিল্প, হাঁস-মুরগি পালন ইত্যাদি। তবে এসব উদ্যোগও স্বল্প পরিসরে সীমাবদ্ধ।

সিসিডিবি (Christian Commission for Development in Bangladesh) তার এনগেজ (ENGAGE) প্রকল্পের মাধ্যমে শ্যামনগরে নারী মৎস্যজীবীদের ক্ষমতায়নে কাজ করছে। এই প্রকল্পের অধীনে নারীদের নেতৃত্ব উন্নয়ন, বিকল্প জীবিকা যেমন- কোয়েল পালন, জলবায়ু সহনশীল কৃষি এবং স্থানীয় পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, ইকোফিশ (ECOFISH) প্রকল্প উপকূলীয় এলাকায় নারীদের সমন্বিত মৎস্য ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করছে। নারীরা এখন কমিউনিটিভিত্তিক কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে অংশ নিচ্ছে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান ও আয় বৃদ্ধি করছে।

সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এসডিএফ (Social Development Foundation) এর বিএসসিএমএফপি  (BSCMFP) প্রকল্পের আওতায় নারীরা কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। এতে তারা মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিকল্প পেশায় দক্ষতা অর্জন করছেন।

কোস্টাল এডুকেশন অ্যান্ড ডাইভারসিটি ইম্প্রুভমেন্ট অরগানাইজেশন- (সিআইডিআইও) শ্যামনগর কলবাড়ি এলাকায় নারী জেলেদের নৌকা দিচ্ছে যাতে মহাজনদের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে দাদন চক্রে না পড়তে হয়। এছাড়া সুপেয় পানির জন্য নারীদের ক্লিন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের জন্য ৪৯ জন নারীকে পানির টাংকি বিতরণ করছে।  এছাড়া ১৪টি পরিবারকে ১৭ হাজার লিটারের ড্রাম দেওয়া হয়েছে বলেও জানান সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক গাজী আল ইমরান।

‘এখানে নারীরা লোনা পানির সাথে প্রতিনিয়ত জীবন অতিবাহিত করছে, জলবায়ুর সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের। আর এসব নারীদের স্বস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা একটি প্রোগ্রাম চালু করেছি। যেখানে আমাদের নারী ভলেনটিয়াররা উঠান বৈঠকে বসে এলাকার নারীদের ঋতুচক্র ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করেন,’ বলেন গাজী আল ইমরান।

সব প্রতিকূলতা, ঋণ, লবণাক্ত পানি, শরীরের যন্ত্রণা পেছনে ফেলে শ্যামনগরের নারী জেলেরা প্রতিদিন ভোরে আবার নদীর পথে হাঁটেন। তাদের হাতে জাল, পিঠে সংসারের বোঝা, আর মনে অদৃশ্য সাহস। নদীর মতোই তারা এগিয়ে চলেন। ভাঙেন, জোড়া বাঁধেন, আবার চলেন। এই নারীরা শুধু মৎস্যজীবীই নন, তারা জলবায়ুর বিরুদ্ধে একেকজন নিঃশব্দ যোদ্ধা।

পিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।