ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

মুজিবের মূর্তি ভাঙার কালে তাজউদ্দীনের গলায় ফুলের মালা

মো. রাজীব সরকার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০৩, আগস্ট ১৩, ২০২৫
মুজিবের মূর্তি ভাঙার কালে তাজউদ্দীনের গলায় ফুলের মালা ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন ফ্যাসিবাদের প্রতীক মুজিবের মূর্তি ভাঙা পড়ছিল, তখন তাজউদ্দীন আহমদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। ছবি: বাংলানিউজ

গাজীপুর: প্রায় দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার প্রাণ কেড়ে নিয়ে অবশেষে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়েছেন—৫ আগস্ট দুপুরে এ খবর খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে রাজপথে নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। আগের কয়েকদিন হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তার দল আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যে হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে গেছে ততক্ষণে।

স্বজন হারানো লোকজনসহ বিক্ষুব্ধরা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ তাদের দলের লোকজনের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর চালাতে থাকে। হাসিনার ফ্যাসিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠা তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন মূর্তি- ভাস্কর্যও ভাঙচুর হতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে।  

ঠিক এই সময়টায় ভিন্নচিত্র দেখলো গাজীপুরের কাপাসিয়ার মানুষ। সেদিন আওয়ামী লীগেরই আরেক প্রয়াত নেতা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাস্কর্য পেয়েছে শ্রদ্ধা। জনতা তার গলায় দিয়েছে ফুলের মালা। এখন পর্যন্ত সেই ভাস্কর্য কাপাসিয়ায় দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, চব্বিশের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা কোনো দেশপ্রেমিককে নয়, উৎখাত করেছে স্বৈরাচারী শাসককে। ফিরিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সাহসিকতায় মানুষ নতুন করে মুক্ত হয়েছে। ফিরে এসেছে গণতন্ত্র।  

তারা বলছেন, তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে থাকলেও দল-মত নির্বিশেষে মানুষ তাকে ভালোবাসে। এর প্রমাণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ছাত্র-জনতার পাহারায় রক্ষা করা হয় তার ভাস্কর্য। স্বৈরাচারী সরকারের দেশত্যাগ ও পতনের পর ছাত্র-জনতা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ভাস্কর্যের সামনে আনন্দ উল্লাস করে। তাজউদ্দীনের ভাস্কর্যে গলায় পরিয়ে দেওয়া হয় ফুলের মালা। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক ও জাতির উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে স্মরণ করা হয়।  

চব্বিশের জুলাইয়ে প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু সেই আন্দোলন ঠেকাতে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্দেশে চালানো হয় গুলি। এতে নিহত হয় নিরীহ সাধারণ ছাত্ররা। ঠিক তখনই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় সাধারণ জনতার। ক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশের জনগণ। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। শুরু হয় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থান দমনে হাসিনা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি নিজ দলের ক্যাডারদেরও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রাজপথে নামিয়ে দেয়। তাদের গুলিতে রক্তাক্ত হয় রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত জনপদও। তবু অভ্যুত্থান দমন করা যায়নি। ৫ আগস্ট পতন হয় ১৭ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে যান দলের প্রধান ও ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আত্মগোপনে চলে যায় দলটির নেতাকর্মীরা, গ্রেপ্তারও হয় অনেকেই।  

ইতিহাস বলে, আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার শুরু থেকে তাজউদ্দীন আহমদ দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। তবু দল-মত নির্বিশেষে এখনো মানুষ তাকে ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। এর দৃষ্টান্ত উদাহরণ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান।  

হাসিনার ফ্যাসিবাদের দমন-পীড়নের ক্ষোভ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর স্থাপনা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, গাজীপুরে আনসার একাডেমিতে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বাংলোবাড়ি যখন ভাঙচুর করা হয়, ঠিক তখন আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের ভাস্কর্যে ফুলের মালা পরিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। গুণী ও স্বচ্ছ রাজনীতির কারণেই মৃত্যুর পরেও মানুষ তাকে এখনো স্মরণ করে ও ভালোবাসে।  

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯২৫ সালে ২৩ জুলাই গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করা হয়। তার ছেলে তানজীম আহমেদ সোহেল তাজ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি ছিলেন গাজীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য। তার স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন রাজনীতিবিদ এবং আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। আরও দুই মেয়ে শারমিন আহমদ রিপি ও মাহজাবিন আহমদ মিমি।  

কাপাসিয়া এলাকার বাসিন্দা মুখলেছুর রহমান জানান, এমন রাজনীতি করা উচিত যাতে যে কোনো পরিস্থিতিতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ দলমত নির্বিশেষে তাকে স্মরণ করে এবং ভালোবাসে। তেমনি একজন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাকে মানুষ ব্যক্তি হিসেবে ভালোবাসে। তিনি একজন স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ ছিলেন। দেশের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার কর্মগুণে তিনি আজও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত। গণঅভ্যুত্থানেও কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যার তীরে দাঁড়িয়ে ছিল এবং এখনো আছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ভাস্কর্য।  

গাজীপুর জেলা বিএনপি নেতা শাহ্ রিয়াজুল হান্নান বলেন, আমরা সহমর্মিতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যতম সহায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি একজন গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তার সম্মান রক্ষায় আমরা এলাকাবাসী ছাত্র-জনতা তার ভাস্কর্য পাহারা দিয়ে রাখি। তিনি সবসময় আমাদের মাঝে সম্মানী ব্যক্তি হয়ে থাকবেন।  

আরএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।