ভারতের টেস্ট ক্রিকেটে এক মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটলো। বিরাট কোহলি, নামটি শুনলেই যে মুখে ভেসে ওঠে আগুনঝরা চোখ আর প্রতিপক্ষকে তীব্র দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ জানানোর দৃশ্য—তিনি হঠাৎ করেই সাদা পোশাককে বিদায় জানিয়ে দিলেন।
ক্রিকেটের সবচেয়ে ধৈর্য ও মানসিক দৃঢ়তা পরীক্ষার ফরম্যাটে কোহলি ছিলেন এক অনন্য সেনানী। তিনি টেস্ট ক্রিকেট খেলেননি, তিনি এটিকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন। মাঠে তার উপস্থিতি মানে ছিল আগুন, গর্জন, এবং অটল মনোযোগ। ব্যাট হাতে ৩০টি শতক, ৯২৩০ রান, একটি যুগ বদলে দেওয়া নেতৃত্ব—এই পরিসংখ্যানের চেয়েও বড় অবদান ছিল তার মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বগুণ।
‘অ্যাগ্রেসন’ আর ‘ফিটনেস’—নতুন সংস্কৃতির জনক
২০১৪ সালে যখন তিনি টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন, ভারত ছিল ধোঁয়াটে ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে। বিদেশে একের পর এক হার, মনোবল হারানো একটি দল। কোহলি শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, এক মেন্টাল কোচ হিসেবে দলকে রূপ দিলেন এক যোদ্ধার রূপে। তার নেতৃত্বে ভারত প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতে নেয় (২০১৮–১৯), দেশে তো ছিলেন কার্যত অপ্রতিরোধ্য।
তিনি ফিটনেসকে ধর্মের মতো মানেন। বিরাট নিজে যেভাবে শরীর ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, তাতে পরবর্তী প্রজন্মের খেলোয়াড়দের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক নতুন পেশাদার মনোভাব। মাঠে তাঁর দৌড়, প্রতিটি বলের প্রতি উৎসর্গ, ‘ইয়ো-ইয়ো টেস্ট’ মানদণ্ড—সবই আজকের টিম ইন্ডিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বিরাট, ব্যক্তি এবং প্রতিভার বিপরীত দ্বৈততা
বিরাট কোহলি ছিলেন আগুন এবং বরফ, দুই-ই। মাঠে ছিলেন উগ্র, প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়ে যেতেন চোখে চোখ রেখে। এমনকি স্টাম্প মাইকে মুখ দিয়ে গালিও শোনা গেছে বহুবার। কিন্তু সেই একই ব্যক্তি লন্ডনে এক অফিসিয়াল রিসেপশনে অতিথিদের অনুরোধ করেছিলেন সিনিয়র খেলোয়াড়দের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য।
তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, নেতৃত্বে কখনোই আপোস করেননি, এমনকি অনেকটা একনায়কোচিত হলেও নিজের কর্তৃত্ব ব্যবহার করেছেন দলের উন্নতির জন্য।
‘টেস্টের রাজা’
যদি ক্রিকেটারদের কীর্তি কেবল সংখ্যায় বিচার হতো, তাহলেও বিরাট সেরাদের মধ্যে থাকতেন। কিন্তু তার আসল কীর্তি হলো—সাদা পোশাকের গুরুত্ব ফেরানো, তরুণদের সামনে একটা মান নির্ধারণ করে দেওয়া, এবং ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ডিএনএ’ বদলে দেওয়া।
৩১৬ জন ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটারের মধ্যে, বিরাট (নম্বর ২৬৮) নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ক্রিকেটীয় রাজবংশের অন্যতম সিংহাসনধারী হিসেবে। তার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র পাতৌদি, গাঙ্গুলি বা ইমরান খানের মতো নেতার।
শেষ কাভার ড্রাইভ, শেষ হুঙ্কার—কিংবদন্তি এখন ইতিহাসে
এই বিদায় বিস্ময়ের। ফিটনেসে যে এখনও ক্রিকেট বিশ্বের সেরা, মাঠে যার আগুন এখনও নিভে যায়নি, এমন একজন খেলোয়াড় কেন হঠাৎ করেই টেস্টকে ‘বিদায়’ বলবেন? হয়তো কোনো ভেতরের সংকেত, হয়তো অতিতিরিক্ত পথচলার ক্লান্তি, হয়তো শুধু সময়।
কিন্তু এটা নিশ্চিত, তার চলে যাওয়া এক শূন্যতা রেখে গেল—যা শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে পূরণ করা যাবে না। টেস্ট ক্রিকেটে আমরা আর দেখবো না সেই আগুনে চোখ, ব্যাট তোলা সূর্যালোকে মেলবোর্নের আকাশের দিকে, বা এলবিডব্লিউয়ের পর সেই গর্জন।
সাদা পোশাক আর তার নাম বহন করবে না। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট তার আত্মায় চিরকাল বহন করে যাবে বিরাট কোহলির স্পন্দন।
এমএইচএম