ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

টরেন্স নদীর দুই কূলেও আবেগের শব্দস্রোতে বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!

অঘোর মন্ডল, অ্যাডিলেড থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫১ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৫
টরেন্স নদীর দুই কূলেও আবেগের শব্দস্রোতে বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!

অ্যাডিলেড: সভ্যতা-ভব্যতার বড়াই ইংলিশরা একটু বেশি-ই করেন। কিন্তু ব্র্যাডম্যানের শহরে একটা হারে তার সবকিছুই যেন ভুলে গেছে তারা!

মাঠের লড়াইয়ে বাংলাদেশের কাছে হারের পর ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ইংল্যান্ড অধিনায়ক আর  কোচ এতো দেরি করে  এলেন যেন তার আগে ইংলিশদের  ড্রেসিংরুমে শোক  হয়েছে।

সেখান থেকে উঠে আসতে পারেননি তারা!

এরপর প্রেস কনফারেন্সের নামে দু’দুটো  ময়না তদন্ত  রিপোর্ট খুঁজলো ইংলিশ মিডিয়া! অধিনায়ক আর কোচের আলাদা আলাদা প্রেসকনফারেন্স! কিন্তু প্রশ্ন প্রায় একই। ইংল্যান্ডের এরকম দুরাবস্থা কেন?

এরপর কি অধিনায়ক হিসেবে মগার্ন দায়িত্বে থাকবেন কি না? কিংবা তাঁর থাকা উচিত কি না? নৈতিক ভাবে ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থায় মর্গান আছেন কিনা? কিংবা কোচ তার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন কি না? ইত্যাদি ইত্যাদি! একের পর এক প্রশ্নের যা ধরন ছিল, তাতে  সংবাদ সম্লেনের আগে ইংলিশ প্রেস একটা কমন প্রশ্নপ্রত্র ধরিয়ে দিতে পারতো তাদের কোচ আর ক্যাপ্টেনের হাতে। সেখানে ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’- দুটো ঘরে টিক চিহ্ন বসিয়ে দিতে পারতেন  ইয়ান মর্গান আর ইংল্যান্ডের কোচ! কিন্তু তা না করে সেই ম্যারথন সংবাদ সম্মেলন করা হলো। বাংলাদেশ মিডিয়াও সেখানে অংশ নিলো।

কিন্তু এরপর এডিলেড ওভালের প্রেসকনফারেন্স হলে যা ঘটলো, সেটা  দেখে মনে পড়লো কয়েক বছর আগে সিডনি টেস্টে হারের পর ভারতের সাবেক অধিনায়ক অনিল কুম্বলের একটা কথা যদিও সেটাও ইতিহাসের পাতা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন কুম্বলে। বডি লাইন সিরিজের পর অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক বলেছিলেন; ‘মাঠে দুটো দল  ছিল।  

কিন্তু একটা দলই নিয়ম মেনে খেলেছে। ’ সেই কথাগুলোর ভাবার্থ ঠিক রেখে একটু সংশোধন করে লিখতে হচ্ছে; ‘মাঠে দুটো দল ক্রিকেট খেলেছে।   কিন্তু একটা দল ক্রিকেটীয় সৌজন্যতায় বিশ্বাসী!’ এবং সেই দলটা অবশ্যই অবশ্যই ইংল্যান্ডর নয়। সেটা ভালভাবে বুঝিয়ে দিলো তাদের মিডিয়া।


ইংলিশ মিডিয়া ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ইংলিশ মিডিয়া যা করলো, তাতে মনে হয়নি একটু আগে মাঠের লড়াইয়ে যে দলটার কাছে ইংল্যান্ড হেরেছ, গত বিশ্বকাপেও চট্টগামে যারা ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল সেই দলটার নাম বাংলাদেশ! বাংলাদেশ জিতেছে এটা যেন মেনেই নিতে পারছে না ইংলিশ মিডিয়া! বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মতুর্জা আর  ম্যান অব দ্য ম্যাচ  মাহমুদউল্ল্যাহ প্রেস কনফারেন্স হলে ঢুকতেই ইংলিশ মিডিয়ার লোকজন  দল বেধে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেলো! ভাবটা এমন এদের কথা আর কি শুনবো! আসলে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক কিংবা ম্যান অফ দ্য ম্যাচের কথা ওরা কি শুনবেন?

ওরা তো এই বিশ্বকাপে পরাজিত অধিনায়কের কথা শুনতে শুনতে আর লিখতে লিখতে ক্লান্ত! ইংল্যান্ড নামক দলটা এই বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত পাঁচটা ম্যাচ খেলে জিতেছে মাত্র একটা ম্যাচে! তাও আবার  প্রতিবেশী স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। যে জয় নিয়ে মেলবোর্ন এজ আবার হেড লাইন করেছিল; ‘ওয়ার্ল্ড কাপ শক: ইংল্যান্ড স্কটল্যান্ডকে হারিয়েছে!’  ক্রিকেটে সৌজন্যতা নামক শব্দটাকে কোথায় ধারণ করে ইংলিশরা সেটা বোঝা গেলো ম্যাচ পরবর্তী সময়ে।

অবশ্য কে বাংলাদেশ দলকে কতোটা সৌজন্যতা দেখালো , তাতে কিছু যায় এসে না। ইংল্যান্ড যখন দেশের বিমান ধরবে ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ দল অকল্যান্ড থেকে মেলবোর্নের বিমান ধরবে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার জন্য। কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ ভারত। কিন্তু সেই ম্যাচ নিয়ে এখনই ভাবতে রাজি নন বাংলাদেশ অধিনায়ক। তার ভাবনায় পরের ম্যাচ। হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। তার আগে অবশ্য কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট বুকিং নয়, কনফার্মও করে ফেললো বাংলাদেশ। ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি অবশ্য পরিস্কার বললেন;‘বিশ্বকাপে আসার আগে হয়তো সবাই চেয়েছেন আমরা নক আউট পর্বে যাই। কিন্তু মুখ ফুটে বলা কঠিন ছিল।

কারণ, অস্ট্রেলিয়া -নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে সেই কাজটা করা কঠিন সেটাও সবার জানা ছিল। তবে ভাল লাগছে সেই কঠিন কাজটা আমরা করে দেখাতে পারলাম। আমি আমার টিমমেট এবং কোচিং স্টাফ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা সবাই মিলে কাজটা করতে পারলাম। বাকি বিশ্বকে দেখাতে পারলাম; আমরাও পারি। ’

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এরকম ইতিহাস গড়া ম্যাচে কার প্রশংসা কতোটুকু করা দরকার সেটা মেপে মেপে বলা কঠিন। তারপরও বাংলাদেশ অধিনায়ক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদউল্লাহ আর মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিঙের। ‘ ওরা দারুন ব্যাট করেছে।   স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে যেখানে শেষ করেছিল, দু’জনেই যেন সেখান থেকে শুর করেছিলেন। তবে কাজটা তাদের জন্য সহজ ছিল না। বিশেষ করে মাহমুদ উল্ল্যাহ ৮ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর উইকেটে আসেন। সেখান থেকে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি। আমার দেখা বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানের অন্যতম সেরা ইনিংস।

শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি অনুযায়ী ওয়ানডে ক্রিকেটে আমার দেখা ভাল একটা ইনিংস। ’ ছোট কিন্তু দলের জন্য খুব প্রয়োজনী এবং সাহসী ইনিংস খেলেছেন সৌম্য সরকার। সেটা প্রথমে বলতে ভুলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। পরে নিজেই তুললেন সৌম্যের সেই ইংনিসের কথা।

আর বাংলাদেশ দলের বোলারদের কথা উঠতেই যেন  জমে থাকা খানিকটা ক্ষোভ উগরে দিলেন বাংলাদেশ  অধিনায়ক। ‘আমাদের পেস বোলারদের প্রতি সম্মান দেখাতে অনেকেই ভুলে যান। আজ তারা প্রমান করলেন আরো একটু সম্মান তাদের প্রাপ্য যেটুকু তাদের দিতে অনেকে কাপর্ণ্য করেন। কুন্ঠাবোধ করেন! আমরাও পেশাদারিত্ব দেখিয়ে শেষ করতে পারি, সেটা আজ কি দেখালেন না বোলাররা?’- প্রশ্ন মাশরাফির। আর উত্তরটা ক্রিকেট বিশ্বের সবার জানা হয়ে গেছে।

কিন্তু একটা বিষয় বোধহয় ক্রিকেট বিশ্বের কেউ জানতেন না। বিশ্বকাপে একটা সেঞ্চুরি চেয়েছিলেন মাহমুদ উল্ল্যাহ। আর সেটাই তিনি পেলেন। ‘ বিশ্বকাপে একটা সেঞ্চুরি করার একটা স্বপ্ন ছিল। মনে মনে খুব চেয়েছিলাম। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে মনে হয়েছিল পেয়েও যেতে পারি। কিন্তু সেদিন পাইনি। আজ অবশ্য সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরির কথা মাথায় ছিল না।

ইচ্ছে ছিল যতোবেশি সময় উইকেটে থাকতে পারবো দলের ততো লাভ। শেষ পর্যন্ত  নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। ওয়ানডেতে প্রথমবার  নব্বইয়ের ঘরে! ৯২ থেকে ৯৬ এ যখন পৌছালাম জেম অ্যান্ডারসনকে বাউন্ডারি মেওে তখন মনে হলো এবার তিন অংকের কথা ভাবতেই হবে। শেষ পর্যন্ত হয়েও গেলো।   ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এই ইনিংসটা ভুলতে পারবো না। ’-আবেগের কথাগুলো বলতে চেষ্টা করলেন তিনি সযত্মে আবেগতে দূরে সরিয়ে রেখে!

কিন্তু আবেগ আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি ম্যাচ শুরুর আগে। জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সময় যখন গাইতে হলো; ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে..আমি নয়ন জলে ভাসি...। ’ মাহমুদল্লাহ  জানালেন এই চরনগুলো গাইবার সময় সত্যিই বার বার তার মায়ের কথা মনে পড়ছিলো। ‘অনেক দিন মাকে দেখি না। মিস করছি। তাই মাকে মনে পড়ছিল। ’ বললেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। আর সেঞ্চুরির পর সেটা তিনি যেভাবে উদযাপণ করলেন, তাতে তার মনে পড়লো স্ত্রী -সন্তানকে। যারা মাঠে ছিলেন না। ছিলেন হোটেল রুমে। তাই মাঠ থেকেই তাদের আবেগের উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দিলেন!

তবে আসল আবেগের স্রোতে ম্যাচ শেষেও টরেন্স নদীর দু’কুলে! সেই আবেগ বাংলাদেশ নামক একটা দেশকে ঘিরে। ‘বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! শব্দের স্রোতে অ্যাডিলেড ওভালের চারপাশে! সেই শব্দটা বোধহয় শুনতে খুব একটা ভাল লাগেনি ইংলিশ মিডিয়ার! কিন্তু ওদের ভাল লাগা -না লাগায় কিছু কি এসে যায়! ভালবাসার বাংলাদেশ শব্দে তখন যে মুখরিত অ্যাডিলেড। ভুল হলো, গোটা অস্ট্রেলিয়া! না, মস্তবড় ভুল হচ্ছে, ৯ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকার রাজপথ থেকে বঙ্গোপসাগর পাড়ের ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়েই যে একটা আওয়াজ ‘বাংলাদেশ!’

বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৫

** নেলসনে টাইগারদের তিন ‘ল্যান্ড’ হার্ডল ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইংল্যান্ড পারলে বাংলাদেশ কেন নয়? । । অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** শচীন আছেন শচীন নেই! | অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ব্রিলিয়ান্ট! সুপার! গ্রেট! অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সাকিব!|| অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** মিরপুর টেক্কা দিচ্ছে মেলবোর্নকে ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** নীল-হলুদ নাকি লাল-সবুজের ঢেউ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** চোক’ কি ক্রিকেটীয় জোক?। । অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** সাকিব-ই সেরা মানতে অসুবিধা কোথায়!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বৃষ্টিবিলম্বিত ক্লার্কের ফেরা! না থেকেও আছেন আশরাফুল॥ ব্রিসবেন থেকে অঘোর মন্ডল
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
** ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।