ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

‘স্বাধীনতাই আমাদের ক্রিকেটের উত্থানে বড় চালিকা শক্তি’

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৮
‘স্বাধীনতাই আমাদের ক্রিকেটের উত্থানে বড় চালিকা শক্তি’ ক্রিকেটার জালাল আহমেদ চৌধুরী, ছবি: শোয়েব মিথুন

ঢাকা: দেশ স্বাধীন না হলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে আজও লাল-সবুজের ক্রিকেটারদের সংগ্রাম করতে হতো। ক্রিকেট দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের যে পরিচয় আজ মিলেছে, বিশ্ব দরবারে মাশরাফি, সাকিবরা যেভাবে হুঙ্কার ছাড়ছেন তা কখনই সম্ভবপর হয়ে উঠতো না।

মূল দলে জায়গা পেতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিবেকহীন নির্বাচকদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। কখন দলে ডাক মিলবে? নাকি মিলবেই না! সেই অনিশ্চিয়তার অন্ধাকারে হাতড়াতে হতো আমাদের দুরন্ত ক্রিকেটারদের।

পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে স্বাধীনতার লাল সূর্যটা ছিনিয়ে আনতে না পারলে হয়তো আজও তাদের পদে পদে নিগৃহীত হতে হতো। স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছেন বলেই সাকিব আল হাসান আজ গোটা ক্রিকেট বিশ্বের নাম্বার ওয়ান অল রাউন্ডারের খ্যাতি পেয়েছেন। পরাধীন থাকলে সেই সম্ভাবনার দুয়ার আজীবন বদ্ধই থাকতো। কোনোদিনই উন্মুক্ত হতো না। এক স্বাধীনতা যেমন আজ বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে, তেমনি তা বাংলাদেশের ক্রিকেটের আজকের এই উত্থানের পেছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এসে সেকথাই জানালেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের খ্যাতিমান কোচ, ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়া বিশ্লেষক, ক্রীড়া লেখক এবং ৭১-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের প্রথম বিভাগের ক্রিকেটার জালাল আহমেদ চৌধুরী।

‘দেশ স্বাধীন না হলে আমরা ওইভাবেই সংগ্রাম করে যেতাম। আগে বাড়াটা হতে না। আমাদের আলাদা কোনও পরিচয় থাকতো না। পাকিস্তানের লেজুড়বৃত্তিই করতে হতো। পাকিস্তান দলে ঢোকাটাই বড় লক্ষ্য থাকতো। আমাদের বিকাশের রাস্তাটা তারা প্রশস্ত করতো করতো না। আমাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা তারা অব্যাহত থাকতো।

আমাদের ক্রিকেটের উত্থানের পেছনে আমাদের স্বাধীনতাই সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি। স্বাধীনতার ফলে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি আমরা স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে ক্রিকেটে মোটা দাগে বৈষম্যের শিকার হয়েছি।
ক্রিকেটার জালাল আহমেদ চৌধুরী, ছবি: শোয়েব মিথুন‘কেমন ছিল সেই বৈষম্য?’-- জানতে চাইলে জালাল আহমেদ ফিরে যান দুঃসহ স্মৃতির সেই আঙিনায়। ‘দল নির্বাচনের সময় ওরা(পশ্চিম পাকিস্তান নির্বাচকমণ্ডলি) আগে ভাগেই তাদের পছন্দমাফিক ক্রিকেটার ঠিক করেই রাখতো। ট্রায়ালের সময় আমাদের ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে একটা বোলার বল করছে; যে কীনা লেগ
স্ট্যাম্পের বাইরে ইনসুইঙ্গার মারছে, অফ স্ট্যাম্পের বাইরে মারছে আউট সুইঙ্গার। ফলে ব্যাটসম্যান ব্যাটে বল লাগাতে পারছে না। ব্যাস বাদ। ’

জালাল আহমেদের চৌধুরীর দাবি, নিজে অতোটা বড় মাপের ক্রিকেটার ছিলেন না বলে ওই ট্রায়ালে তার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে তার আশেপাশে এমন কয়েকজন বড় ভাই ছিলেন যারা পাকিস্তান দলে খেলার যোগ্য ছিলেন। অথচ সেই প্রতিভাবানদের দাবিয়ে রেখেছিলেন পাক নির্বাচকেরা।

‘আমার সময়ে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় ছিল যারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। টেস্ট খেলতে পারতো। শামীম কবির, আব্দুল মজিদ কোরআন, এনায়েত হোসেন সিরাজ, মইনউদ্দিন মাহমুদ, লুৎফর রহমান মাখন, মাহমুদুল হাসান বকুল। এদের ভেতরে মাহমুদুল হাসান বকুল ছিলেন উঁচু মানের ব্যাটসম্যান। আলতাফ ভাই (সৈয়দ আলতাফ হোসেন) ভাল বোলার ছিলেন। একবার নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাকিস্তান স্কোয়াডে সুযোগ পেয়েছিলেন। ’

বঞ্চিত প্রতিভাবান সেই বড় ভাইদের কথা বলতে বলতে বন্ধু, শহীদ জুয়েলের প্রসঙ্গ টেনে আনেন দেশের ক্রিকেটাঙ্গনের প্রতিথযশা এই মানুষটি। সেই সাহসী ক্রিকেটার শহীদ জুয়েল, যিনি ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে আজম ট্রফিতে পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। ব্যাট-হাতে মাঠে নামতেন ওপেনিং অর্ডারে। খেলতেনও দুর্দান্ত। দারুণ স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ে নজর কাড়তেন সবার।

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্টে গভীর রাতে পাক সেনাবাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তৎকালীন তেজগাঁওয়ে এমপি হোস্টেলের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি এই মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটারের।

‘আমাদের বন্ধু ছিল। এক দলে খেলিনি। তার বিরুদ্ধে একই লিগে খেলেছি। জুয়েল খুব সাহসী ও প্রাণবন্ত ব্যাটসম্যান ছিল। আজকের ব্যাটসম্যানদের দেখি টি-টোয়েন্টিতে স্লগ সুইপ খেলে, তখন ম্যাটিং উইকেটে হেলমেট নাই, থাইগার্ড নাই সে পেস বলের ওপর স্লগ সুইপ করতো। বড় কলিজাওয়ালা ব্যাটসম্যান ছিল। মারমুখী ওপেনার, উইকেট কিংপিং করতো। হৈচৈ করতো না, চুপচাপ খেলতো। পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলেছে। ক্লাব ক্রিকেট খেলেছে আজাদ বয়েজ, মোহামেডানে। ’

৭১ এর রণাঙ্গনে জুয়েল হারিয়ে গেলেও আজও বেঁচে আছেন তার আরেক বন্ধু, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান। অগ্নিঝরা মার্চের সাথে রকিবুল হাসানের ঐতিহাসিক সেই ম্যাচটির কথা বেশ গর্বভরেই বললেন জালাল।

‘মার্চের সাথে ক্রিকেটের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরেও যখন ৩ মার্চ ইয়াহিয়া খান অধিবেশন দেবেন না, গণবিস্ফোরণের চূড়ান্ত পর্যায় তখন। ওইদিন স্টেডিয়ামে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়; পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে। সেই পাকিস্তান দলে রকিবুল খেলেছিল। ইয়াহিয়া খান অধিবেশন না ডাকায় দেশ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলে সেই খেলাটা ভণ্ডুল হয়ে যায়। ’

বন্ধু রকিবুলের মতো পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে কখনই খেলা হয়ে ওঠেনি জালাল আহমেদ চৌধুরীর। উদিতী ক্লাবের হয়ে খেলেছেন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট। তখন প্রিমিয়ার লিগ বলতে কিছু ছিল না। আজকের প্রিমিয়ার লিগের মতো ঘরোয়া ক্রিকেটে তখন প্রথম বিভাগই ছিল সর্বোচ্চ মানের ক্রিকেট। পরিতাপের বিষয় হলো সে সময়ের সেই ঘরোয়া ক্রিকেটেও ছিল বৈষম্য।
ক্রিকেটার জালাল আহমেদ চৌধুরী, ছবি: শোয়েব মিথুন‘আমি প্রথম ক্রিকেট খেলেছি ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগে ১৯৬৬ সালে, ১৯৬৫-৬৬ মৌসুমে। তখন আমি উদিতী ক্লাবে। বর্তমানের ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, মিরপুর এই থানাগুলোর পূর্ব পাকিস্তানে আমরা যেকজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতাম সেদলেও আমরা ১১জন বাঙ্গালি থাকতাম না। ওরা করাচি লাহোর থেকে এসে লিগ খেলতো এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতো। তাদের ভেতর থেকেই বেশিরভাগ খেলোয়াড় নির্বাচিত হতো। পাকিস্তানের ক্রিকেটে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থান নাজুক অবস্থায় ছিল। তখন পাকিস্তান দলে আমাদের বাঙালি কেউ খেলবে এটা স্বপ্নের মতো ছিল। ইস্ট পাকিস্তানে যতটুকুই ক্রিকেট হতো সেটা ডমিনেট করতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বা বাঙালি-নন-এমন ক্রিকেটাররা। ’

এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে ক্রিকেটে বলতে কিছু থাকারই কথা ছিল না। প্রশ্ন হলো, তাহলে কীভাবে আছে? সেই প্রশ্নের উত্তরও মিললো তার কথায়: ‘তখনও রঙিন পোশাক আসেনি। তখনকার ক্রিকেটে যেহেতু লাহোর, করাচির ক্রিকেটাররা ডমিনেট করতো, তাই জাতীয় দলে খেলার আশা বা প্রণোদনা খিছুই ছিলই না। জাতীয় দলের রাস্তা অনেক লম্বা মনে হতো। খুব সীমিত সংখ্যক লোকের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে উৎসাহ ছিল। এই সীমিত সংখ্যক লোকগুলোই অনেক সংগ্রাম করে ’৭১ পরবর্তী সময়ে ক্রিকেটের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল। ’

তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা যারা ক্রিকেটের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিলেন। কৃতজ্ঞতা সেসকল বীর সেনানীর প্রতি, যারা ’৭১ এর রণাঙ্গনে প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছেন। আজ যে ক্রিকেট এদেশের ১৬ কোটি মানুষের গর্বের উৎস, যে ক্রিকেট বিশ্ব দরবারে লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে ওড়ায় সে ক্রিকেট তো সেইসব মুক্তিযোদ্ধার অসীম বীরত্বগাথা ও ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত।
মহান স্বাধীনতা দিবসে তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৮
এইচএল/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।