ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

শিক্ষা নগরীর শিক্ষা ব্যবসা-১

ময়মনসিংহে কলেজে ভর্তি ফি নিয়ে নৈরাজ্য

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৬ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪
ময়মনসিংহে কলেজে ভর্তি ফি নিয়ে নৈরাজ্য ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা এখন ব্যস্ত উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ভর্তির দৌড়ঝাঁপে। আর এ ভর্তি বাণিজ্যের ভরা মৌসুমে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে নতুন স্টাইল নিয়েছে শিক্ষা নগরী ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ।



ডিশ ক্যাবলে অবৈধ বিজ্ঞাপন প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি শহরের প্রধান প্রধান সড়কে ব্যয়বহুল ব্যানারসহ তোরণ নির্মাণ, ডিজিটাল ব্যানার আর দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে তারা দেদারছে প্রচারণা চালাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, সরকারি নির্দেশ অমান্য করে তারা অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায় করছে। এসবের মাধ্যমে এক শ্রেণীর শিক্ষা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সুকৌশলে গলা কেটে নিজেদের পকেট ভারি করছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহ শহরে প্রায় অর্ধ শতাধিক উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ রয়েছে। এসব বেসরকারি কলেজ প্রায় মাসখানেক ধরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি শুরু করে। বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে এরা মূলত ভর্তি বাণিজ্যে নামে। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদেরও।  

নাম ও প্রচারণা সর্বস্ব এসব কলেজ হচ্ছে- ক্যাপিটাল কলেজ, ফ্লোরেস কলেজ, ময়মনসিংহ আইডিয়াল কলেজ, ময়মনসিংহ সিটি কলেজ, ন্যাশনাল পাবলিক কলেজ, ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল কলেজ, রিফ্লেক্স কলেজ, ইডেন গার্লস কলেজ (মহিলা মানবিক কলেজ) ও প্রাইম সেন্ট্রাল কলেজ।

সূত্রমতে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের লোভনীয় অফার দিয়ে প্রভাবিত করে প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর ধরে এসব কলেজ শিক্ষার নাম করে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বেশিরভাগ কলেজেরই বিজ্ঞাপনী প্রচারের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। ভাড়াটিয়া ভবনে এসব কলেজ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম।

চটকদার বিজ্ঞাপন কিংবা মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আবার আয়কর দেয়ার সময় শিক্ষার্থী সংখ্যা কম দেখানো হচ্ছে বলেও গুঞ্জণ রয়েছে। বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে এসব কলেজে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ ও নামমাত্র সম্মানী দেয়া নিয়েও নানামুখী প্রচারণা আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিজেদের দুর্বলতা ঢেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভেড়াতে বিভিন্ন কলেজ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও নামি শিক্ষকদের নাম তাদের প্রচারপত্রে সন্নিবেশিত করেছে। আবার কোন কোন কলেজ তাদের প্রচারপত্রে আগের সবকিছু ঠিকঠাক রেখে এবার শুধু উপদেষ্টা মণ্ডলীতে কিছু পরিবর্তন এনেছে।

এমনই একটি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ক্যাপিটাল কলেজ। শহরের আমলাপাড়া এলাকার ৩ তলা ভবনের দুতলার এ কলেজটি মূলত গড়ে উঠেছে একটি ভাড়াটিয়া বাসায়। এ কলেজের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের প্রসপেক্টাসে উপদেষ্টামণ্ডলীর তালিকায় এফবিসিসিআই পরিচালক, বিশিষ্ট শিল্পপতি আমিনুল হক শামীম ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা মোহিত উর রহমান শান্ত’র নাম ছিল।  

কিন্তু ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের প্রসপেক্টাসে তাদের নাম নেই। তাদের স্থানে শোভা পাচ্ছে নতুন উপদেষ্টার নাম! এ বিষয়টিকেও স্থানীয় শিক্ষানুরাগী মহল এ কলেজের প্রতারণা হিসেবেই দেখছেন। তবে এ বিষয়ে কলেজটির সমাজ কল্যাণ বিভাগের প্রভাষক নাজমুল হক জানালেন চমকপ্রদ তথ্য। তিনি বলেন, বছর ঘুরতেই উপদেষ্টা মণ্ডলীতে পরিবর্তন আনা হয়।

এ কলেজের প্রচারপত্রে উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আনন্দমোহন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডা. গাজী হাসান কামাল। ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে প্রসপেক্টাসে নাম রয়েছে সরকার জসিমের। কলেজটির এসব মিথ্যাচার প্রসঙ্গে জানতে চাইলেই তিনি নিজেকে ‘সাংবাদিক’ বলে পরিচয় দেন এবং কোন কথা বলবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।  

তবে কলেজটির প্রিন্সিপাল মো. মনোয়ার হোসেন খান মিনারকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে আকস্মিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি ক্ষেপে যান। অগ্নিমূর্তি নিয়ে তেড়ে এসে তিনি বলেন, মিডিয়ায় আমাদের অসঙ্গতি তুলে ধরে লিখুন। এতে আমরা হাইলাইটস হবো। আর উপদেষ্টামণ্ডলীতে এখন তাদের দরকার নেই, এ কারণে এবার রাখিনি।

এদিকে, এসব কলেজে শিক্ষার্থীদের লোভনীয় অফার দেখিয়ে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের মনগড়া ভর্তি ফি আদায় করা হচ্ছে উন্নয়ন ফি কিংবা বিভিন্ন খাতের নাম করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত এ টাকা নেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। উন্নয়ন অথবা বিভিন্ন ফি’র নাম করে এসব টাকা নেয়া হচ্ছে।

ভর্তি নীতিমালায় বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ১৯২ টাকার কথা উল্লেখ থাকলেও নামসর্বস্ব কয়েকটি কলেজের মধ্যে ক্যাপিটাল কলেজ ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, ফ্লোরেজ কলেজ ৫ হাজার টাকা, ময়মনসিংহ আইডিয়াল কলেজ ৪ হাজার ৮০০ টাকা, ময়মনসিংহ সিটি কলেজ ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ন্যাশনাল পাবলিক কলেজ ৫ হাজার টাকা, রিফ্লেক্স কলেজ ৪ হাজার টাকা, ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল কলেজ ৫ হাজার ২শ’ টাকা, ইডেন গার্লস কলেজ (সাবেক মহিলা মানবিক কলেজ) ৫ হাজার ৬শ’ টাকা ও প্রাইম সেন্ট্রাল কলেজ ৫ হাজার টাকা ভর্তি ফি বাবদ আদায় করছে।

ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল কলেজের প্রিন্সিপাল আমিনুল হক, আবার তার স্ত্রী ফারজানা নাসরীন হলেন ইডেন গার্লস কলেজ (সাবেক মহিলা মানবিক কলেজ) এর প্রিন্সিপাল।

শিক্ষা নগরীর কলেজগুলোর শিক্ষা বাণিজ্য নিয়ে চরম উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. রফিকুল হক বলেন, ‘বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো এ কলেজগুলো গজিয়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে সরকারের তীক্ষ্ণ নজরদারি প্রয়োজন। যাতে করে বাণিজ্যিক কনসেপ্ট থেকে নিরাপদে থাকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।

এ ব্যাপারে ঢাকা মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ প্রশাসন) ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, বোর্ড নির্ধারিত ফি’র বাইরে ভর্তি ফি নিয়ে এরকম নৈরাজ্য বিধিসম্মত নয়। যেসব কলেজ এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।