ঢাকা: এক ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তার কারণে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। দুর্নীতির কারণে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া ওই কর্মকর্তা আবার ফিরে এসে প্রতিষ্ঠানটিতে পদোন্নতিও পেয়েছেন।
অভিযুক্ত ইউজিসি’র ওই কর্মকর্তার নাম ফেরদৌস জামান। তিনি অতিরিক্ত পরিচালক হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দেখভাল করেন।
কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা ফেরদৌস জামানের বিরুদ্ধে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। আবার সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার পরও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসাবেও মাসিক ভাতা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ফেরদৌস জামানের দুর্নীতি সম্পর্কে সে সময়ের ইউজিসি চেয়ারম্যান এটিএম জহুরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, দুর্নীতির জন্য তাকে শুধু বরখাস্তই করিনি, তাকে চেয়ারম্যানের রুমেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন শুনছি, তিনি নাকি ইউজিসি’র অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এ ধরনের অসৎ কর্মকর্তা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির জন্যই ক্ষতিকর।
তার দুর্নীতি সম্পর্কে অবহিত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেও। গত ৬ জুলাই সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা একজন ইউজিসি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ পেয়েছি। আমি ইউজিসি চেয়াম্যানকে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।
তবে অভিযুক্ত ফেরদৌস জামান তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ইউজিসি’র দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সামনে আসে।
এহেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সমালোচনার মুখে পড়ে ইউজিসি। শিক্ষামন্ত্রীও সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করেন ।
টিআইবি’র ওই প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ করার জন্য সরকার ইউজিসি’র মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ কমিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর কাছে ইউজিসি’র কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বিষয়ে তথ্য আহবান করে।
আর এতেই ফাঁস হতে শুরু করে ফেরদৌস জামানের দুর্নীতির যাবতীয় তথ্য।
ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুষ
কুমিল্লার বিশ্বরোডের পদুয়ার বাজারে অবস্থিত নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি’র তদন্ত কমিটিকে লিখিতভাবে ফেরদৌস জামানকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার কথা জানায়।
যদিও ফেরদৌস জামান এ অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়ে ঝামেলা আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের একজন আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের ছোট ভাই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র। আমিও ওই বিভাগের ছাত্র ছিলাম। সেই হিসেবে তাকে চিনতাম। অন্য কাউকে চিনিও না।
কয়েকদিন হলো এ ধরনের একটি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এক অজ্ঞাত ব্যক্তির ই-মেইল থেকে এটা ছড়ানো হচ্ছে। আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। তাছাড়া আমি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে কাজ করি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি কিছু না-- যোগ করেন ফেরদৌস জামান।
আর ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগের বিষয়ে কিছু কনফিউশন আছে। যিনি অভিযোগ করেছেন, তিনি এখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নেই। আবার এখন যিনি আছেন তিনি বর্তমানে লন্ডনে আছেন। তিনি আবার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দেখা যাক, তদন্তে কী বের হয়ে আসে।
তবে তার (ফেরদৌস জামান) বিরুদ্ধে অতীত ও বর্তমানের আরো কিছু অভিযোগের কথা আমি শুনেছি। এর বেশিরভাগই আমার সময়ের না- বলেন ইউজিসি চেয়ারম্যান।
তিনি লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর
ফেরদৌস জামান তার প্রভাব খাটিয়ে বেসরকারি লিডিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আর্থিক সুবিধা আদায় করেছেন। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে রেভিনিউ স্টাম্পের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন যার নথি বাংলানিউজের হাতে এসেছে।
এছাড়া ইউজিসি থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে টেলিফোন বিল, গাড়ি ও আবাসিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে ফেরদৌস জামানের বিরুদ্ধে।
তদন্ত কমিটির সদস্য, তারপর বিদেশ ভ্রমণ
রাজধানীর উত্তরার ওয়াইড ভিশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাঁচজন পরিচালক প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়া অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক আবু জাফর খানের ‘অনৈতিক ও নিবর্তনমূলক’ কাজের প্রতিকার চেয়ে ইউজিসি’র কাছে আবেদন করেন।
আবেদনে শিক্ষক আবু জাফর খানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। ইউজিসি বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি কমিটি করে দেয়। তিন সদস্যের এ কমিটির একজন ছিলেন ফেরদৌস জামান।
সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে যে, ফেরদৌস জামান তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে আবু জাফর খানের পক্ষে প্রতিবেদন দিয়ে বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা আদায় করেছেন।
ফেরদৌসের ‘দুর্নীতিতে ডুব সাঁতার’
ইউজিসি’র এক কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন সদস্যের কাছে ফেরদৌস জামানের ‘দুর্নীতিতে ডুব সাঁতার’ দেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন ২০১২ সালে। এ বিষয়ে ইউজিসি সচিব বরাবর একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন।
যদিও তার ৯ বছর আগেই ফেরদৌস জামান দুর্নীতির কারণে ইউজিসি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন।
বাংলানিউজের হাতে আসা নথিপত্রে দেখা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ফেরদৌস জামানকে ২০০৩ সালের ৫ এপ্রিল সাময়িক বরখাস্ত করে ইউজিসি কর্তৃপক্ষ।
সে সময়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মোফাক্কের হোসেন স্বাক্ষরিত বরখাস্ত আদেশে বলা হয়, ‘জনাব ফেরদৌস জামান, সহকারী পরিচালক (গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ) এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিপির কপি প্রশাসন বিভাগের সাধারণ শাখা থেকে সংগ্রহকরণ ও কমিশন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যাতিরেকে উক্ত পিপির ফটোকপি এবং বেশ কয়েকটি অনুষদ, বিভাগ ও কোর্স সংক্রান্ত একটি অনুমতিপত্র ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণের অভিযোগসহ আরো কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হয়। যা তদন্তের জন্য দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং কমিটির তদন্তে তা প্রমাণিত হয়’।
‘...তার বিরুদ্ধে এরূপ আচরণ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ এর (৩) (বি) বিধি মোতাবেক ‘মিস কন্ডাক্ট’ বা ‘অসদাচরণ’ ও ৩ (ডি) বিধি মোতাবেক ‘করাপ্ট’ বা ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ এর পর্যায়ভূক্ত অপরাধ। ’
এরপর বিধিমালার ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে ফেরদৌস জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা বলা হয় আদেশে।
ফেরদৌস জামানের এসব দুর্নীতির বিষয়ে ইউজিসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করেছি। এ কমিটিতে ইউজিসি’র কেউ নেই। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহ্জালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে এ কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুর্নীতি করে কেউই রেহাই পাবেন না। আবার কাউকে অযথা হয়রানিও করা হবে না বলেও মন্তব্য করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৪