ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

আমাদের একজন জামাল ভূঁইয়া আছেন

উপল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৯
আমাদের একজন জামাল ভূঁইয়া আছেন দর্শকদের সঙ্গে জামাল ভূঁইয়া

ম্যাচ তখন শেষ। শিরোপা পুনরুদ্ধার করতে না পারার ক্ষত নিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম আবাহনীর খেলোয়াড়রা। সামান্য দূরে দাঁড়ানো কোচ-কর্মকর্তাসহ চ্যাম্পিয়ন তেরেঙ্গানু এফসি দলের সদস্যরা। কিছুক্ষণ আগেই শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে ২-১ ব্যবধানে ফাইনাল জয়ের আনন্দ তাদের চোখেমুখে। আর কিছু সময় পর শিরোপা উঁচিয়ে ধরার জন্য তাদের ডাকা হবে পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে। এমন সময় গ্যালারি থেকে চিৎকার উঠল, ‘জামাল, জামাল।’

সবার নজর তখন দর্শকদের প্রতি। জামাল ভূঁইয়া এগিয়ে গেলেন তাদের দিকে।

গা থেকে খুলে ছুড়ে দিলেন তার ‘৬’ নাম্বার জার্সি।  প্রিয় খেলোয়াড়ের জার্সি লূফে নেওয়ার জন্য মুহূর্তে বাড়িয়ে দিল অগণিত হাত। কিন্তু অধিক হাতের জোরে জামাল ভূঁইয়ার জার্সি গেল ছিঁড়ে।  

দর্শকদের সঙ্গে জামাল ভূঁইয়াজামাল ভূঁইয়ার এই জার্সি নিয়ে আরেকটি গল্প বলা যাক। গ্রুপ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে লাওসের ইয়ং এলিফেন্টসের বিপক্ষে ম্যাচের পরেরদিন হোটেল আগ্রাবাদের এক সংবাদ সম্মেলনের ঘটনা। অপরাহ্নে সাংবাদিকরা সবাই ছুটলেন সেদিকে। প্রথমে কথা বললেন চট্টগ্রাম আবাহনী কোচ মারুফুল হক। এরপরে এলেন ক্লাবটির মিডফিল্ডার আরিফুল ইসলাম। সবাইকে অপেক্ষায় রেখে হাসিমুখে নিচে নামলেন জামাল।  

ইয়ং এলিফেন্টসের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের খোলস ছেড়ে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকায় একটি গোল করার পাশাপাশি ম্যাচ সেরাও হয়েছেন জামাল। সামনে কলকাতার মোহনবাগানের বিপক্ষে ম্যাচ। সেই উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলন। শুরুতে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, গোল পেয়েছেন, কেমন লাগছে? আপনি তো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেন। এবার খেললেন অ্যাটাকিংয়ে… 

কোচ মারুফুল হকের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে জামাল ভূঁইয়াজামাল খুব ভালো বাংলা বলতে পারেন না। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত সংবাদ সম্মেলনের গল্পটা শেষ করা যাক। জামালের উত্তরটা ছিল এরকম, ভালো লাগছে গোল করে। কোচ আমাকে যেখানে খেলতে বলে আমি সেখানেই খেলি। ‘নাম্বার সিক্স’ খুব বেশি গোল পায় না। কিন্তু ল্যাম্পার্ড (ফ্রাঙ্ক) এই পজিশনে খেলে অনেক গোল পেয়েছেন। আমি সব পজিশনে খেলতে পারি।  

‘গোলরক্ষক হিসেবে?’ এক সিনিয়র সাংবাদিক পাল্টা জানতে চাইলেন।  

জামাল তার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন, ‘নাইস গাই। ’ 

তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল। জামাল এমনই। যখন তিনি মাঠে নামেন গ্যালারির দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। যখন সংবাদ সম্মেলনে আসেন তখন সাংবাদিকরাও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তার উত্তর শুনে। সব আলো যেন জ্যোতি ছড়ায় জামালকে ঘিরে। তেমন একদিনের গল্প। ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন চলছে। খেলার মধ্যকার অনেক প্রশ্নোত্তর পর্বের পর এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, জামাল, আপনি তো ভালো বাংলা বলতে পারেন না। সতীর্থদের সঙ্গে সময় কাটে কিভাবে?

উত্তর যেন প্রস্তুত ছিল জামালের ঠোঁটে, ‘আমি বলি তারা শুনে। তারা বলে আমি শুনি। এভাবেই। আমার বাংলাটা আরো উন্নতি করতে হবে। ’

এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে শেখ কামাল ক্লাব কাপের ফাইনাল দেখতে আসা দর্শকের একাংশজামাল কেবল সংবাদ সম্মেলনে নয়, মাঠের বাইরেও স্বতঃস্ফূর্ত। বল পায়ে যখন মাঠ দাপিয়ে বেড়ান তখন প্রতিপক্ষ তটস্থ থাকে কখন এক ডিফেন্স চেরা পাসে তিনি ছিন্নভিন্ন করে দেবেন তাদের। সদ্য সমাপ্ত শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে তেমনই তো দেখা গেল জামালকে। পরপর দুই ম্যাচ ম্যাচ সেরা হয়েছেন তিনি। সেমিফাইনালেও দুর্দান্ত খেলে চট্টগ্রাম আবাহনীকে ফাইনালের টিকেট এনে দিয়েছেন জামাল।  

মোহনবাগানের বিপক্ষে ম্যাচের আগের আরেকটি ঘটনা। যদিও জামাল কিছুতেই ‘মোহনবাগান’ বলতে পারেন না। জিহবা জড়িয়ে যায়। হয়তো এটা প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের একটা কৌশল তার কাছে। সে যাক। জামালকে দেখা গেল ফুটপাতে কাপড় কিনতে। ছবিটি পরে ভাইরালও হয়।  

এসব টুকরো টুকরো ঘটনা কেবল জামালের ব্যক্তিগত দিক। মাঠের জামাল আরো ভয়ানক। কয়েকদিন আগে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে তা সবাই দেখেছে। তার ফ্রি-কিক, পুরো মাঠ দাবড়িয়ে বেড়ানো, ডিফেন্স চেরা পাস, গোলের দক্ষতা, সব মিলিয়ে এক ‘টোটাল’ ফুটবলার জামাল ভূঁইয়া।  

বাংলাদেশ বনাম ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে জামাল ভূঁইয়াক্লাব ও দেশের হয়ে ‘৬’ নাম্বার জার্সি পড়ে খেলেন জামাল। এই ‘নাম্বার সিক্স’ দেখলেই মনে পড়ে জাভি হার্নান্দেজের কথা। মাঝমাঠে কৌশল সাজিয়ে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, লিওনেল মেসির সঙ্গে জুটি বেঁধে বার্সেলোনাকে কত শিরোপাই না এনে দিয়েছেন এই স্প্যানিশ কিংবদন্তি মিডফিল্ডার। জামাল হয়তো ‘জাভি’ কাতারের নন। হয়তো এখনো শিরোপা ওঠেনি তার হাতে। কিন্তু এটাও তো গর্বের যে, আমাদের একজন জামাল ভূঁইয়া আছেন। যিনি ডেনমার্কের ফুটবল ছেড়ে দেশের ফুটবলকে সোনালী অতীত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চলে এসেছেন বাংলাদেশে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৯
ইউবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।