লন্ডন: আগামী ২১ অক্টোবর পূর্ব লন্ডনের বাঙালি পাড়াখ্যাত টাওয়ার হ্যামলেটস এর প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচন। টাওয়ার হ্যামলেটসের ভোটাররা এদিন সরাসরি প্রথম মেয়র নির্বাচিত করবেন।
মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পূর্ব লন্ডনের বাঙালি পাড়া টাওয়ার হ্যামলেটস এখন ব্রিটিশ রাজনীতির মূল আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।
নবনির্বাচিত লেবার নেতা এড মিলিব্যান্ড এর সামনে এটিই প্রথম চ্যালেঞ্জ।
ব্রিটেনের অভিবাসী বাঙালিদের মধ্যে লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা ঐতিহ্যগতভাবে একটি স্বীকৃত বিষয়। নির্বাচনে লেবার, কনজারভেটিব, লিবারেল ডেমোক্রেটসহ সব দলই নিজ নিজ প্রার্থি দিয়েছে।
লেবার প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন বারার কেবিনেটের বর্তমান নেতা কাউন্সিলার হেলাল উদ্দিন আব্বাস। লেবার পার্টির পে তাকে মনোনয়ন দেওয়ার আগে আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত কাউন্সিলার, সাবেক কাউন্সিল নেতা লুৎফুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের জামায়াতের ইসলামীর ইউরোপীয় সংষ্করণ ইসলামিক ফোরাম ইউরোপ ও জর্জ গ্যালওয়ে নেতৃত্বাধীন রেসপেক্টের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ও লেবার পার্টির সদস্য সংগ্রহে জালিয়াতির অভিযোগে লেবার পার্টির ন্যাশনেল এক্সিকিউটিভ কমিটি (এনইসি) লুৎফুরের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে পরবর্তীতে হেলাল আব্বাসকে মনোনয়ন দেয়। ুব্ধ হয়ে লুৎফুর স্বতন্ত্র প্রার্থি হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেন।
তাকে সমর্থন দিচ্ছে গ্যালওয়ের রেসপেক্টসহ বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামির ইউরোপীয় সংস্করণ ও চ্যানেল ৪ এর ভাষায় আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গি সংশ্লিষ্ট সংগঠন ইসলামিক ফোরাম ইউরোপ (আইএফই) ও অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠন। আর হেলাল আব্বাসের পে মাঠে নেমেছেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাং®কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা।
টাওয়ার হ্যামলেটসের আসন্ন মেয়র নির্বাচনকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন লেবার পার্র্টির নবনির্বাচিত নেতা এড মিলিব্যান্ড। পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়া এবং বিগত পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলের পরাজয়ের পর এটিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কোন নির্বাচন হওয়ায় এড মিলিব্যান্ড এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করেছেন।
লেবার পার্টির নিরাপদ সংসদীয় আসনের এই মেয়র নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে প্রায় প্রতিদিনই বাঙালি পাড়া সফর করেন প্রার্থী হেলাল আব্বাসের পে ভোট চাইছেন লেবার পার্টির তারকা নেতা ও সাবেক মন্ত্রীরা।
স্থানীয় এমপি রোশনারা আলী সার্বনিকই আছেন মাঠে।
কট্রর লেবার বিরোধী মৌলবাদী হিসেবে পরিচিত দল রেসপেক্ট বিদ্রোহী লেবার কাউন্সিলার স্বতন্ত্র প্রার্থী লুৎফুরকে সমর্থন দেওয়ায় আব্বাসের পে আটঘাট বেধে মাঠে নেমেছেন লেবার সমর্থকরা। নির্বাচনী প্রচারের শেষের দিকে এড মিলিব্যান্ডেরও আসার সম্ভাবনা রয়েছে বাঙালি পাড়ায়।
উল্লেখ্য, বাঙালি অধুষ্যিত টাওয়ার হ্যামলেটসের দুটো সংসদীয় আসন লেবারের নিরাপদ আসন হিসেবে বিগত কয়েক দশক থেকেই পরিচিতি বহন করছে। ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেনের জড়িত হওয়ার কারণে ২০০৫ সালের নির্বাচনে এই দুটোর একটি বেথনালগ্রীন ও বো, রেসপেক্ট নেতা জর্জ গ্যালওয়ে ছিনিয়ে নিলেও বিগত ২০১০ সালের মে মাসের নির্বাচনে বাঙালি কন্যা রোশনারা আলী আবার এটি পূনোরুদ্ধার করেন।
বিগত কয়েক দশক থেকেই টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় মতাসীন হয়ে আসছে লেবার পার্টি। বারার মোট ৫১টি ওয়ার্ডের অধিকাংশেই নির্বাচিত হয়ে আসছেন লেবার প্রার্থিরা। এর মধ্যে বাঙালি লেবার কাউন্সিলারদের সংখ্যাই বেশি। কাউন্সিল কেবিনেটে লীডার ও মেয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদও অনেক সময় দখলে থাকছে বাঙালি কাউন্সিলারদের।
ব্রিটেনের স্থানীয় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী বারা বা কাউন্সিলগুলোতে জনগনের সরাসরি ভোটে ৫ বছরের জন্য কাউন্সিলাররা নির্বাচিত হন।
লেবারের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত লুৎফুর
সাবেক কাউন্সিল নেতা লেবার কাউন্সিলার লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে মৌলবাদী সংগঠন আইএফই ও রেসপেক্ট সম্পৃক্ততার অভিযোগই মূলত তাঁর বিরুদ্ধে কাল হয়ে দাড়ায়। তাছাড়া পার্টির অভ্যন্তরে নিজে ও আইএফই সমর্থকদের শক্তি বাড়ানোর ল্েয তিনি নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিজের পকেট থেকে ফি দিয়ে পার্টির সদস্য সংগ্রহ করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
কাউন্সিল লীডার থাকাকালীন রেসপেক্টের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আইএফই’র ইন্ধনে তিনি মৌলবাদীদের স্বার্থ রায় কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। আর এসব অভিযোগের কারনেই লেবার পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটি মেয়র পদে মনোনয়নয় পাওয়ার পরও তা বাতিল করে বলে লেবার পার্টির একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানায়।
একই অভিযোগে বিগত কাউন্সিল নির্বাচনের পর কেবিনেট লীডার হিসেবেও লুৎফুর মনোনয়ন বঞ্চিত হন। তার বিরুদ্ধে রেসপেক্ট সম্পৃক্ততার অভিযোগ তিনি বরাবর অস্বীকার করে আসলেও মেয়র নির্বাচনে লেবার পার্টির মনোয়ন পাওয়ার পর তার প্রতি রেসপেক্ট এর আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণাকে তাঁর রেসপেক্ট সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবেই আমলে নেয় লেবার পার্টির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরাম ন্যামনেল এক্সিকিউটিভ কমিটি (এনইসি)।
লেবার প্রার্থীরই মেয়র হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেহেতু এই নির্বাচনে জিততে লেবারকে রেসপেক্টের সমর্থণ নিতে হয়েছে, ব্রিটিশ রাজনীতিতে এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে এই সমর্থন রেসপেক্ট এর একটি কৌশল বলেই ধরে নেয় এনইসি। রেসপেক্ট এর এই কৌশলী ষড়যন্ত্রের জালে পা দিতে চায়নি লেবার পার্টি। ফলে ভাগ্য বিপর্র্যয় ঘটে লুৎফুরের।
বিগত পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে চ্যানেল-৪ এর ডেসপাচেজ নামক একটি ডকুমেন্টারীতে সাবেক বৃটিশ পরিবেশ মন্ত্রী তৎকালীন লেবার কাউন্সিল নেতা লুৎফুরের দিকে অভিযোগ করেছিলেন। ঐ ডকুমেন্টারীতে তৎকালীন লেবার দলীয় কাউন্সিল লীডার লুৎফুর রহমানকে আইএফই’র অনুপ্রবেশকৃত ব্যাক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে জামাত সমর্থক আইএফই ধারা পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠনকে কাউন্সিল ফান্ডের সুবিধার অভিযোগ আনা হয়।
লন্ডনের পপুলার এবং ক্যানিংটাউনের বর্তমান লেবার দলীয় এমপি ও সাবেক বৃটিশ পরিবেশ মন্ত্রী জিম ফিজ পেট্রিকের অভিযোগ ছিল, জামাত-এর স্থানীয় ফ্রন্ট আইএফই তাঁর নিজ দল লেবারের স্থানীয় শাখায় অনুপ্রবেশ করে পার্টিকে দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে।
তাঁর অভিযোগ ছিল, ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে আইএফই ভূয়া সদস্য তৈরী করে লেবার পার্টিতে অনুপ্রবেশ করিয়েছে এবং স্থানীয় নির্বাচনে তাদের পছন্দের লোকদের বিজয়ী করে কাউন্সিল নেতৃত্ব দখল করার মাধ্যমে এরা স্থানীয় পর্যায় থেকে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টায় আছে।
আইএফই লেবারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের অভ্যন্তরে গোপন গ্র“প গঠন করে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে, যা লেবার পার্টির বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রোগ্রামকে বাধাগ্রস্থ করছে বলেও তখন জিম ফিজ পেট্রিক অভিযোগ করেছিলেন। জিমের এই অভিযোগের পর আইএফই তাদের প্রার্থি রেসপেক্ট নেতা জর্জ গ্যালওয়েকে নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমে তখন জিমকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু সারা দেশে লেবারের নির্বাচনী বিপর্যয় ঘটলেও টাওয়ার হ্যামলেটস এর স্থানীয় ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের শিকার হয় আইএফই ও রেসেপেক্টসহ লেবার বিরোধীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১০