ঢাকা: লিঙ্গ বৈষম্য, সহিংসতা ও শোষণ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে জি-২০ ভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে নারীদের জন্য সবচে আদর্শ স্থান কানাডা। নারীর স্বাভাবিক জীবন-যাপন এবং মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষায় সবচে ইতিবাচক অবস্থানের কারণে সবচে নারীবান্ধব বলে বিবেচিত হয়েছে দেশটি।
অপরদিকে কন্যা ভ্রুণ ও শিশু হত্যা, বাল্যবিয়ে এবং নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বেহাল দশার কারণে ভারতে নারীদের জন্য সবচে প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের আইন বিষয়ক সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট ল বুধবার এ তথ্য প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ৬৩টি দেশের উত্তরদাতা এবং ৩শ’ ৭০ জন জেন্ডার বিশেষজ্ঞের মতামত জরিপের ভিত্তিতে এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তারা।
বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে পরিচালিত জরিপের ফলাফল অনুসারে- দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্স।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক্ষেত্রে ৬ষ্ঠ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে প্রজনন অধিকার এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গর্ভপাত বিষয়ে সংকীর্ণতা এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার অপর্যাপ্ততার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের অবস্থান নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন তারা।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার, পারিবারিক সহিংসতা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ, চলাফেরা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচক মতামত প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল ওমেন’ম রাইটস অ্যাকশন ওয়াচের পরিচালক মার্শা ফ্রিম্যান বলেছেন, ‘গত ১শ’ বছরে আমাদের নানা অর্জনকেই প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ অধিকার বাধাগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ’
নারীবন্ধব দেশ হিসেবে জরিপের ফলাফলে জি-২০ ভূক্ত অন্য দেশগুলোর অবস্থানের ক্রম হচ্ছে- জাপান, ইতালি, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, তুরস্ক, রাশিয়া, চীন, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব এবং সবশেষে ভারত।
ভারতের পরেই নারীদের জন্য খারাপ স্থান সৌদি আরব। এ দেশের নারীরা সুশিক্ষিত হলেও তাদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। আর ২০১১ সালে এসে নারীরা ভোটাধিকার পেল।
জরিপে মত দেওয়া সেভ দ্য ইউকে’র স্বাস্থ্য কর্মসূচি বিষয়ক উন্নয়ন উপদেষ্টা গুলশান রেহমান ভারত প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভারতে নারীরা এখনো অস্থাবর সম্পত্তির মতো বিক্রি হয়, বছর দশেক বয়সেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়, যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পারায় পুড়িয়ে মারা হয়, গৃহকর্মীর মতই স্ত্রীরা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়। ’
ভারতে ২০০৫ সালের পারিবারিক সহিংসতা আইন শুধু নামেই রয়েছে। কিন্তু নারীদের অধিকার রক্ষায় এর কোন কার্যকর প্রয়োগ নেই বলে মন্তব্য করেন গুলশান রেহমান।
ফলাফল অনুসারে ভারত ও সৌদি আরবের অবস্থান প্রসঙ্গে সাংবাদিক ও ‘হাফ দ্য স্কাই: টার্নিং অপ্রেশন ইনটু অপরচুনিটি ফর ওমেন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’র লেখক নিকোলাস ক্রিস্টোফার সতর্ক করে বলেছেন, নারী অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় যেসব দেশ ব্যর্থ হয়েছে অথবা প্রতিবন্ধকতা জিইয়ে রেখেছে তাদেরকে বহুকাল ধরে এর ফল ভোগ করতে হবে।
ট্রাস্ট ল’র প্রতিবেদন অনুসারে, ঝুঁকির দিক থেকে মেক্সিকোও আছে প্রথম সারিতে। এ দেশে নারী অধিকার সবচে হুমকির সম্মুখীন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এখানে নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়। নারীর স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে সবচে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা আফ্রিকার চেয়েও খারাপ অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো।
অ্যামনেস্টি ইউএসএ’র তথ্য মতে, মেক্সিকোর নারীরা মাদক সংক্রান্ত সহিংসতার হাত থেকেও রেহাই পায় না। কেবল ২০১১ সালেই ৩শ’রও বেশি নারী সিউদাদ হুয়ারেজ সীমান্ত এলাকায় নিহত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আগামী ১৮-১৯ জুন মেক্সিকোতে জি-২০’র বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সম্মেলনকে সামনে রেখে জি-২০ভূক্ত দেশগুলোতে নারী বিষয়ক আইন ও চুক্তি সত্ত্বেও সেখানে নারীর বর্তমান দুর্দশা চিহ্নিতকরণ ও তার ভিত্তিতে নারীর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের লক্ষ্যে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ট্রাস্ট ল’র এই জরিপে প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাদে জি-২০ভূক্ত ১৯টি দেশকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
নারীর জন্য জি-২০ভূক্ত দেশগুলোর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য জেন্ডার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সহায়তাকর্মী, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, নীতিনির্ধারক, সাংবাদিক এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতামত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
ইউনাইটেড ন্যাশনস ওমেন, ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, অ্যামনেস্টি ইউএসএ, অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালসহ নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষজ্ঞদের মত জানতে চাওয়া হয়।
নারীর জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা, সহিংসতা থেকে নিরাপত্তা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, কর্মসংস্থানের সুবিধা, শিক্ষার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণের অধিকার, গৃহদাসত্ব থেকে মুক্তি- এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে দেশগুলোর অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে।
তবে পরিসংখ্যানের পরিবর্তে শুধুমাত্র মতামত ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে এ জরিপ অনুষ্ঠান করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে জেন্ডার ইনইকুয়েলিটি ইন্ডেক্সের পরিচালিত অপর এক সমীক্ষায় সবচে খারাপ অবস্থানে ছিল সৌদি আরব। আর সবচেয়ে ভাল অবস্থানে ছিল জার্মানি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: শামসুন নাহার ও জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর