কলকাতা: প্রয়াত হলেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। ৬ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে তিনি কলকাতার ২, বেলতলা রোডের নিজ বাসভবনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯২০ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুন্সীগঞ্জ জেলায় হাঁসাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার সহধর্মিনীর নাম মায়া রায়। তিনি এখনো জীবিত। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় কিছুদিন ধরেই কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। বাড়িতে রেখেই তার কিডনির নিয়মিত ডায়ালিসিস চলছিল। মাস কয়েক আগে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জগতে এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো।
১৯৫৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ডা.বিধান চন্দ্র রায়ের মন্ত্রী সভায় যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। অশোক কুমার সেনের হাত ধরে তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন। এরপর ১৯৬০ সালে তিনি প্রথমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে তিনি ভারতের শিক্ষা ও যুব কল্যাণমন্ত্রী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাকে পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়তে তাকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠান। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ৭২ থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হিসেবে অত্যন্ত দতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে দেশের মানুষের নজর কাড়েন। সব কিছুতেই তিনি বরাবর ছিলেন প্রকৃতই একজন রাজনৈতিক অভিভাবক, বলিষ্ঠ, সাহসী এবং নির্ভীক প্রশাসক। তার মৃত্যুতে একটি যুগেরও অবসান হলো।
তার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর শেষকৃত্য আজ রোববার বিকেলে কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশান ঘাটে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হবে।
সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বেশ কয়েক বছর ধরে সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি কংগ্রেসের সঙ্গেও না। কিন্তু, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তিনি তাদের সব রকম পরামর্শ দিতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি রাজ্যপালের বাসভবন রাজভবনে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এম কে নারায়ণের সঙ্গে দেখা করে জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযান এবং সিপিএম-এর সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে অভিযোগ জানান।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ছিলেন একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কখনও বিরোধী দলের নেতা, কখনও শাসক দলের কাণ্ডারী, কখনও দলের মধ্যে বিদ্রোহীসহ নানা ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তার মন্ত্রীসভার মন্ত্রীদের দুর্নীতির তদন্ত করতে ওয়াংচু কমিশন বসিয়েছিলেন। আবার মতবিরোধের কারণে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে নবকংগ্রেস গঠন করেছিলেন। তার সঙ্গে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। বিভিন্ন বিষয়ে ইন্দিরা তার মতামত গ্রহণ করতেন। তারই পরামর্শে দেশ জুড়ে ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী; যার কারণে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর ভরাডুবি হয়।
১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বরাহনগর কেন্দ্রে সিপিএম-এর প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বরাহনগরসহ রাজ্যের সব বিধানসভা কেন্দ্রে রিগিং হচ্ছে, এই অভিযোগ তুলে সিপিএম নির্বাচন থেকে নিজেদের সব প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয়। এ সময়ে থেকেই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়-এর বিরুদ্ধে সিপিএম প্রচারে নামে। অভিযোগ করা হয়, কাশিপুর বরাহনগর গণহত্যাসহ ১ হাজার ১শ সিপিএম কর্মী হত্যার জন্য তিনি দায়ী। যদিও তার সঙ্গে ব্যক্তি জ্যোতি বসুর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। বয়সে ছোট হলেও তিনি জ্যোতি বসুকে প্রকাশ্যে নাম ধরে ডাকতেন।
বাগ্মী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আইনের ওপর ব্যুৎপত্তি ছিল অসাধারণ! রাজনীতির জগৎ ছাড়াও সারা ভারতে উচ্চ ন্যায়ালয়ে আইনজীবী হিসেবে তার অনেক সম্মান ছিল এবং তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় লড়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক এবং নানান বিষয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করে যেতে পারতেন।
রাজনৈতিক মহলে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় সবার কাছে ‘মানুদা’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে, তিনি ছিলেন একজন ক্রীড়ামোদীও। খেলার মাঠে এক সময় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল এবং তিনি ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড অব বেঙ্গল (সিএবি)-র প্রেসিডেন্টও ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। এ আত্মজীবনীতে তিনি ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা, শাহ কমিশন, নকশাল আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে অকপটে অনেক কথা বলেছিলেন।
এই আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে আসা বঙ্গবন্ধুকে ভারত সরকারের হয়ে অভ্যর্থনা জানাতে যান।
বিমানবন্দরে উপস্থিত অগণিত জনতা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইলে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বক্তব্য শুরু করলে জনতা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বাংলায় বলতে অনুরোধ জানায়। অবাঙালি এই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে বঙ্গবন্ধু বাকরুদ্ধ হয়ে যান। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় তখন তাকে বাংলায় বক্তব্য দিতে অনুরোধ জানান। এরপর বঙ্গবন্ধু বাংলায় তার আবেগঘন বক্তব্য রাখেন। এই লেখাতে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় আরো উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের প্রতীক একটি রূপার নৌকা তাকে উপহার দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অসামান্য অবদান রাখার জন্য।
তার বাসায় আসা সাংবাদিকদের তিনি এই নৌকাটি দেখিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন। বলতেন, আমি একবার হাসিনাকে এ নৌকাটি দেখাতে চাই। তার কাছে থাকা একটি ছবি যাতে ইন্দিরা গান্ধী, তিনি ও বঙ্গবন্ধুসহ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়েছেন। এটিও তিনি সবাইকে দেখাতেন। বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু বিদায় নিলেন একেবারে অযাচিতভাবেই! বাংলাদেশ হারালো তার এক অকৃত্রিম বন্ধুকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১০