ঢাকা: ২০১০ সালের বেশ কয়েকটি ঘটনা দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর মধ্যে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের দৃষ্টিতে পাঠকদের জন্য সবচেয়ে আলোচিত ১০টি নির্বাচিত ঘটনা।
১. চিলির ৩৩ শ্রমিক
দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময় ধরে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭০০ মিটার নিচে ৩৩ খনিশ্রমিকের আটকে থাকার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম।
চিলির আতাকামা মরুভূমির সান হোসে খনিটি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মনোযোগ কাড়ে । সবা মানুষ সমস্বরে প্রত্যেক শ্রমিকের জীবনের জন্য প্রার্থনায় মেতে উঠে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর সব অঞ্চল ৩৩ খনিশ্রমিকের মাটির নিচের প্রতিটি মুহূর্ত সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতে শুরু করে।
২০১০ সালের ৬ আগস্ট মাসে একটি দুর্ঘটনায় ৩৩ শ্রমিকের সবাই আটকে পড়ে। ধরেই নেওয়া হয়েছিল সবারই সলিল সমাধি হয়ে গেছে। কিন্তু না, সব অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করে ১৭ দিন পর তারা মাটির নিচ থেকেই উদ্ধারকাজে নিয়োজিত দলের কাছে সংকেত দিতে সমর্থ হয় ‘আমরা বেঁচে আছি’।
২. ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হাইতি
বছরের শুরুর দিকেই অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি ইতিহাসের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ক্যারিবীয় দেশ হাইতি। রেডক্রসের হিসেবে অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসেবে দুই লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। প্রেসিডেন্ট ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতিসংঘ মিশনের কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ বহু স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
আহত মানুষের সংখ্যাও কম নয়--আড়াই লাধিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছে হাইতিতে কর্মরত জাতিসংঘের শান্তিরী বাহিনীর বহু কর্মী। রা পাননি বিদেশি নাগরিকও। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, ফ্রান্স, জার্মানি, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, তাইওয়ান ও যুক্তরাজ্যের বহু নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ভূমিকম্পের পরপরই হাইতির সাহায্যে এগিয়ে আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা, চীন, রাশিয়া, নিউজিল্যান্ড, পেরু, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও পানামা হাজার হাজার কোটি ডলারের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে।
সম্প্রতি কোলেরা, নির্বাচীন সহিসংতা, রাজনৈতিক স্থবিরতা নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপ দেশটি।
৩. আইসল্যান্ডের ছাইমেঘ
আইসল্যান্ডের একটি আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্গিরণে নির্গত ছাই পুরো ইউরোপের আকাশ ছেয়ে ফেলে। ফলে বিমান চলাচল ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে। নরওয়ে, পোল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলিজিয়াম, ব্রিটেন, রাশিয়াসহ ইউরোপের সব প্রায় দেশই আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ছাইমেঘের আক্রান্ত হয়। ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া এ অচলাবস্থা প্রায় এক সপ্তাহ চলে। প্রায় এক লাখ ফাইট বাতিল করা হয়। বিমানবন্দরগুলোয় লাখ লাখ যাত্রী আটকে থাকে। কোটি কোটি ডলার লোকসানের মুখ দেখে বিমানসংস্থাগুলো। এছাড়া আইসল্যান্ডের কৃষি ও পর্যটন মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়।
৪. ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা
এ বছর ইরানের বিরুদ্ধে চতুর্থ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। গত ৯ জুন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য দেশ এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। স্থায়ী পাঁচ সদস্য হচ্ছে, পাঁচ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন।
ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে এমন সন্দেহে সমুদ্রবন্দর ও ভূমধ্যসাগরে ইরানের মালবাহী জাহাজগুলোতে তল্লাশি চালাতে পারবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আরও রয়েছে, তেহরানের কাছে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, যুদ্ধবিমান, রণতরী ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র কোনো দেশ বিক্রির করতে পারবে না। এ ছাড়া পরমাণু অস্ত্রবিস্তার কর্মসূচির সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে এমন সন্দেহে ইরানি ব্যাংকগুলোর শাখা, সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এতে ইরানি ব্যাংকগুলোর লেনদেনের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়, রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্যদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সরকার অভিযোগ করে আসছে, ইরান জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা উপো করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা অব্যাহত রেখেছে। তাদের দাবি, তেহরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে।
তবে ইরানের সরকার বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশে পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনা করছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ দাবি করেন, ইরান এখন পরমাণু সমৃদ্ধ দেশ।
৫. মেক্সিকো উপসাগরে তেল উত্তোলনমঞ্চে বিস্ফোরণ
মেক্সিকো উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের কাছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের (বিপি) একটি তেল উত্তোলনমঞ্চ বিস্ফোরিত হয়। এতে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে।
ডিপওয়াটার হরাইজন নামের ওই মঞ্চ থেকে লাখ লাখ ব্যারেল তেল সমদ্রে মিশে যায়। এতে বহু সাম্রদ্রিক প্রাণী, মানুষ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রায় ২২০ কোটি ডলারের লোকসানের মুখ দেখে বিপি। যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার নতুন প্রশাসনও ব্যাপক সমালোচনায় মুখে পড়ে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় এক মাইল নিচে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। ফলে বিপির প্রকৌশলীরা তেল ছড়িয়ে পড়া বন্ধে বারবার ব্যর্থতার মধ্যে পড়ে। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮৬ দিন তেল ছড়িয়ে পড়ার পর প্রকৌশলীরা দাবি করেন তারা তেলকূপটির ছিদ্র বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
গত ২০ এপ্রিল বিস্ফোরণের এ ঘটনায় তেলকূপ খনননীতি নিয়েও প্রশ্ন দেখা যায়। মার্কিন প্রশাসন এক সময় নতুন করে এ নীতি প্রণয়ন করতেও বাধ্য হয়।
৬. পাকিস্তানের বন্যা
পাকিস্তানে জুলাই মাসে ভারী বৃষ্টিপাতের পর ভয়াবহ বন্যার ঘটনায় দুই সহস্রাধিক মানুষ মারা যায়। মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে। দেশটির খাইবার পাখতুনখোয়া, সিন্ধু, পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তানের মতো প্রদেশগুলোই মূলত এই বন্যা আঘাত হানে। পাকিস্তানি সরকারে তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে প্রায় ২ কোটিরও বেশি লোক এতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই তাদের সম্পত্তি, জীবিকা, ঘরবাড়ি হারায়।
জাতিসংঘ ও বিশ্বের বিভিন্ন ধনী দেশ তাদের সহায়তার হাত বাড়ায়। জাতিসংঘ থেকে ৪৬ কোটি মার্কিন ডলার জরুরি অর্থসহায়তা দেওয়া হয়।
৭. অং সান সুচির মুক্তি
মিয়ানমারের সামরিক সরকার অং সান সু চিকে মুক্তি দেয় ১৩ নভেম্বর। ১৯৮৯ সালের ২০ জুলাই গ্রেপ্তারের পর গত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই তিনি ছিলেন গৃহবন্দী। তারপরও তিনি গণতন্ত্রের জন্য সামরিক সরকারের সঙ্গে আপোষ-আলোচনা-সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করেননি। বরং মুক্তি পাওয়ার পরপরই বলেছেন, তিনি আলোচনায় বসতে আগ্রহী।
মিয়ানমারে ১৯৬২ সাল থেকে সেনাবাহিনী মতায় রয়েছে। জেনারেল থান শোয়ে সু চিকে গৃহবন্দী রেখে গত ৭ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। এতে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দলকে নিষিদ্ধ করে জান্তা সরকার।
৮. থাইল্যান্ডে লাল জামাধারীদের বিক্ষোভ
থাইল্যান্ডে গত মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চলা লাল জামাধারী ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ৯০ জনের বেশি লোক নিহত হয়। আহত হয় দুই সহস্রাধিক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থক হিসেবে পরিচিত লাল জামাধারীরা রাজধানী ব্যাংককের কেন্দ্রস্থল দখল করে রাখে। লাল জামাধারীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী অভিজিত ভেজ্জাজিভাকে পদত্যাগ করতে হবে এবং দেশে সাধারণ নির্বাচনের আহ্বান করতে হবে।
প্রথমদিকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েক হাজার এতে থাকে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় লাল জামাধারীদের ছত্রভঙ্গ করা সম্ভব হয়।
৯. কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা
পীত সাগরে গত ২৬ মার্চ উত্তর কোরিয়ার ছোড়া টর্পেডোর আঘাতে দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধজাহাজ চেওনান ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৪৬ জন নাবিক নিহত হয়। কোরীয় উপদ্বীপে এ নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং তা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া এ ঘটনায় পিয়ংইয়ংকে দায়ী করে। এছাড়া একটি আন্তর্জাতিক তদন্তেও উত্তর কোরিয়া দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
তবে এ অভিযোগ বরাবরই নাকচ করে আসছে উত্তর কোরিয়া।
১০. উইকিলিকস ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ ফেলে দেওয়া ভিন্নধারার গণমাধ্যম উইকিলিকস মার্কিন প্রশাসনের গোপন সব তথ্য ফাঁস করে দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসে। এমনকি কোপানলের শিকার হয় এর এডিটর-ইন-চিফ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। সুইডেন তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির জন্য অভিযোগ এনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। লন্ডনের পুলিশ তাকে গত ৭ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে। এরপর লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সপ্তাহজুড়ে শুনানি চলার পর তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্বের গোপন সব নথি ফাঁস দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় উইকিলিকস প্রায় আড়াই লাখ গোপন মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তা ফাঁস করে দেয়। এতে বিশ্বের বহু থেকে দেশের মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটন পাঠানো গোপন তথ্য রয়েছে। বাংলাদেশও এর থেকে রেহাই পায়নি।
মার্কিন প্রশাসন থেকে উইকিলিকসের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ভিসা, মাস্টারকার্ডসহ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান তার অর্থ লেনদেন বন্ধ দেয়।
তবে এরইমধ্যে বিশ্বজুড়ে উইকিলিকস ও অ্যাসাঞ্জের অনেক অনুরাগী তৈরি হয়। তারাও ইন্টারনেটে পাল্টা প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। আক্রমণ করে বসে বিভিন্ন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভøাদিমির পুতিন, বাজ্রিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা, বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কিসহ বহু মানুষ অ্যাসাঞ্জের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, উইকিলিকসের পরের চমক হতে যাচ্ছে বিশ্বের বহু নামিদামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গোপন তথ্য ফাঁস।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০