ব্রাজিলের ইতিহাসে নিজের নামটি সোনার হরফে লিখে নিয়েছেন দিলমা রৌসেফ। দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শনিবার তিনি শপথ নিয়েছেন।
দিলমা রৌসেফের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ব্রাজিলের মিনাস গেরাইসের বেলো হরিজনটিতে। মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। বাবা ছিলেন বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। রাজনৈতিক চাপে তিনি দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যান। পরে আর্জেন্টিনা থেকে ব্রাজিলে এসে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি হয়ে ওঠেন সফল ব্যবসায়ী। মারা যান ১৯৬২ সালে।
বাবার কাছেই রৌসেফের পড়াশোনার হাতেখড়ি। এরপর শিখেছেন ফ্রেঞ্চ, পাশাপাশি শিখেছেন পিয়ানো। ১৫ বছর বয়সে তিনি সেন্ট্রাল স্টেট হাই স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলের ছাত্ররা ব্রাজিলের সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল। ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলের বাম সরকারকে পরাজিত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এই সেনা শাসন ছিল ২১ বছর।
রাজনৈতিক বাবার যোগ্য মেয়ে হিসেবে তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতেন। বাবার আদর্শই তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলে। ১৯৬৭ সালে তিনি ব্রাজিলিয়ান সোস্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার বন্ধু ফরাসি সমাজতান্ত্রিক ও সাংবাদিক রেজিস ডেবরায়ের লেখা ‘রেভ্যুলেশন ইনসাইড দ্য রেভ্যুলেশন’ পড়ার পর তিনি সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেন। হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত গেরিলা। রেজিস ডেবরায়ই তাকে মার্কসবাদ শিখিয়েছিলেন।
অস্ত্রের ব্যবহার এবং পুলিশের মুখোমুখি গেরিলা কৌশল কীভাবে খাটাতে হয়, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। আর সে সময় সেনাবাহিনী তার নাম দিয়েছিল ‘জোয়ান অব আর্ক’। তার রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও আন্ডারগ্রাউন্ড সক্রিয়তার কথা পরিবারের সবাই জানতেন।
১৯৭০ সালে তিনি গ্রেফতার হন। অভিযোগ আছে, গ্রেফতারের পর তার ওপর এমন কোনো নির্যাতন নেই যা চালানো হয়নি। তাকে বৈদ্যুতিক শক ও বিশেষ ডিভাইস দিয়ে হাড়ের জোড়ায় ও মাংসপেশীতে ২২ দিন ধরে নির্যাতন চালানো হয়। এরপর শাস্তি হিসেবে তাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড ও আঠারো বছর তার জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য পরে শাস্তি কমিয়ে আনা হয়। প্রায় তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৭৩ সালে রৌসেফ মুক্তি পান।
মুক্তির পর তিনি অর্থনীতি নিয়ে আবারও পড়াশোনা শুরু করেন এবং ১৯৭৭ সালে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। কয়েক বছর চাকরি করেন। এরপর ধীরে ধীরে রাজনীতির পথে চলতে চলতে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৯৩ সালে স্টেট গভর্নর রিও গ্র্যান্ডি ডো সোল তাকে এনার্জি সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন। কিন্তু এক বছর পরই তিনি ওই পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
মাস্টার্স শেষ না করেও তিনি পিএইচডির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু এর মধ্যেই ১৯৯৯ সালে তিনি বিদ্যুৎ, খনি ও যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান।
২০০১ সালে তিনি লুলার ওয়ার্কাস পার্টিতে যোগ দেন। ২০০২ সালে তিনি লুলার নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে লুলা রৌসেফকে বিদ্যুৎ ও খনি মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন।
২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট লুলার চিফ অব স্টাফ বা মন্ত্রী পরিষদের প্রধান দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হন। ব্রাজিলে এই পদে সাধারণত তাকেই নিয়োগ দেওয়া হয়, যিনি প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে কাছের। লুলার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন রৌসেফ। আর তাই তাকেই এই সম্মনজনক পদে বসানো হয়।
ব্রাজিলে লুলার জনপ্রিয়তা আকাশসমান। কিন্তু পরপর দু’বার নির্বাচিত হওয়ায় সাংবিধানিক বাধার কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে পারেননি। আর তাই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার জন্য লুলাই তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আর এ বিষয়টিই রৌসেফের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতা সহজ করেছে। এছাড়া নির্বাচনের আগে রৌসেফ বারবার অঙ্গীকার করেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে তিনি লুলার নেওয়া পদপেগুলোই এগিয়ে নিয়ে যাবেন৷
তার জয় হয়েছে। গত অক্টোবরে কয়েক পর্যায়ের নির্বাচনে জিতে গত শনিবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিলের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে ওঠেছে। চীন ও ভারতের পর বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশটিকে বিবেচনা করা হচ্ছে। দেশটির সমাজ ব্যবস্থায় সমতার অভাব খুব বেশি। তবে এক সময়ের মার্কসবাদী গেরিলা নেতা আজ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। দেখা যাক সফলতার ধারাবাহিকতায় তিনি সমাজে কতটুকু সমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময় : ০৮৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১১