ঢাকা: কুনুতে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বিংশ শতাব্দীর বিস্ময় মানব নেলসন ম্যান্ডেলা। নশ্বর দেহত্যাগ করলেও মানবতাবাদের অবিনশ্বর ক্ষমতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকলেন তিনি, থাকবেন বহুকাল।
ফুসফুসজনিত রোগে ৯৫ বছর বয়সে এ মাসের ৫ তারিখে জোহনেসবার্গের নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন চলে গেলেন এ মহামানব।
স্থানীয় সময় সকাল সাতটা ৫৫ মিনিটে বিশ্বের বরেণ্য ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্বের উপস্থিতে শেষকৃত্যানুষ্ঠান শুরু হয় এই মহামানবের। শেষকৃত্যানুষ্ঠান শেষে সামরিক বাহিনী ও ম্যান্ডেলার স্বজনেরা তার শবদেহ বিশেষ ব্যবস্থায় বহন করে সমাধিস্থলে নিয়ে যান।
রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠান হলেও কুনু গ্রামটি অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানে বিশেষ অতিথি ও স্বজন ছাড়া কাউকে উপস্থিত না থাকার অনুরোধ জানিয়েছিল দেশটির সরকার। তারপরেও এই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত ছিলেন সাড়ে চার হাজার মানুষ। আর পরোক্ষভাবে উপস্থিত ছিলেন সারাবিশ্বের কোটি প্রাণ।
ম্যান্ডেলার ছেলেবেলা কেটেছে প্রত্যন্ত এই কুনু গ্রামে। তখন কে জানতো এই ছোট্ট ছেলেটি একদিন বিশ্বজয় করবে, মোহমুগ্ধ করে রাখবে সারা বিশ্বকে, পৃথিবীব্যাপী রেখে যাবে অসংখ্য অনুসারী?
কুনুর সেই ছোট্ট বালকটিই মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে একদিন বিশ্বজয় করলেন। সবশেষে আবার ফিরে এলেন সেই প্রত্যন্ত গ্রামেই। এ গ্রামেরই পারিবারিক সমাধিস্থলে ঘু্মোচ্ছেন ম্যান্ডেলা।
গত ১০ ডিসেম্বর গুড়িগুড়ি বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই ৯৫ হাজার উপস্থিতি ধারণে সক্ষম জোহানেসবার্গের সকার সিটি স্টেডিয়ামে প্রিয় ম্যান্ডেলার স্মরণানুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সঙ্গে জড়ো হওয়া হাজারো মানুষ প্রিয় নেতাকে শেষ বিদায়ের শোকে বিহ্বল হয়ে ওঠেন।
স্মরণানুষ্ঠানে বান কি-মুন, বারাক ওবামা, প্রণব মুখার্জী, দিলমা রৌসেফ, রাউল কাস্ট্রো ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন, জিমি কার্টার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান প্রেসিডেন্ট জোচিম গ্যঁক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের প্রেসিডেন্ট জোসে ম্যানুয়েল বারোসো, ডাচ রাজা উইলেম আলেক্সান্ডার, স্পেনের যুবরাজ ক্রাউন প্রিন্স ফিলিপ, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসাইন, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে প্রমুখ।
স্মরণানুষ্ঠানের পর গত বুধ থেকে শুক্রবার পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বস্তরের জনগণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত এই নেতার মরদেহ প্রিটোরিয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার বাসভবন ‘ইউনিয়ন বিল্ডিং’-এ রাখা হয়। সেখানে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান লক্ষাধিক মানুষ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মানুষের চাপ সামলাতে না পেরে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর লাইনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে দেশবাসীকে সতর্ক করে দেয় সরকার।
যে মুহূর্তে এ সতর্কতা দেওয়া হয় তখনও দেশজুড়ে ৫০ হাজার মানুষ ম্যান্ডেলাকে দেখতে প্রিটোরিয়ায় আসার জন্য বাসের অপেক্ষা করছিলেন।
শনিবার প্রিটোরিয়া থেকে অবিসংবাদিত এই নেতার মরদেহ কুনু গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয় সময় দুপুর দেড়টার দিকে সি-১৩০ নামে একটি সামরিক এয়ারক্রাফটে তার মরদেহ কুনুতে পৌঁছায়। আঞ্চলিক রীতি অনুযায়ী ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা এই সফরের সঙ্গে ছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় পতাকা মোড়ানো ম্যান্ডেলার মরদেহ বিমান থেকে নামানোর পর তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়। তারপর গাড়িতে করে ম্যান্ডেলা বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু হয়।
এ সময় রাস্তায় পাশে থাকা শত শত মানুষ পতাকা উড়িয়ে, গান গেয়ে শোক প্রকাশ করে। যে পথ দিয়ে ম্যান্ডেলার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সেপথে স্থানীয় জনগণ বিশাল মানববন্ধন তৈরি করে। মানববন্ধনের উদ্দেশ্যে একটাই, নিজ গ্রামের এই বৈশ্বিক নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো।
ম্যান্ডেলার সংক্ষিপ্ত জীবন:
ম্যান্ডেলার ছোটবেলা কাটে তার নানাবাড়িতে। ডাকনাম ছিল রোলিহ্লাহ্লা। পারিবারিক নাম মাদিবা। ম্যান্ডেলা ছিলেন তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়েছেন। স্কুলে পড়ার সময় তার এক শিক্ষিকা ইংরেজিতে তাঁর নাম রাখেন নেলসন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল পার্টি নামক আফ্রিকনাদের দল জয়লাভ করে। তারা ছিল বর্ণবাদী। ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার পরই ম্যান্ডেলা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯৬১ সালে ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখোন্তো উই সিযওয়ের (সংক্ষেপে এমকে) নেতৃত্ব নেন। তিনি এই সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা করেন।
প্রয়োজনে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনাও করেন ম্যান্ডেলা। ১৯৮০’র দশকে এমকে বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করে। সে যুদ্ধে নিহত হয় অনেক বেসামরিক লোক। পরবর্তীতে সেকথা স্বীকার করেন ম্যান্ডেলা।
১৯৬২ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতাসহ নানা অপরাধে গ্রেফতার করে। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবাসের ১৮ বছর কাটে রোবেন দ্বীপের কারাগারে। ১৯৮৮ সালে তাকে ভিক্তর ভার্স্টার কারাগারে নেওয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত পরবর্তী সময়টুকু তিনি ছিলেন এখানেই।
কারাবাসে থাকাকালীন বিশ্বব্যাপী ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বর্ণবাদবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ম্যান্ডেলার দীর্ঘ কারাবাসের অবসান ঘটে।
মুক্ত হওয়ার পর নেলসন ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এই দলের নেতা ছিলেন তিনি। সে সময়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন। এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হয়। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৯১ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রথম জাতীয় সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে ম্যান্ডেলাকে দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় অবদান রাখার জন্য ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ম্যান্ডেলা। এছাড়াও শাখারভ পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি।
২০০৯ সাল থেকে জাতিসংঘের ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩
সম্পাদনা: কামরুল হাসান কাইউম, নিউজরুম এডিটর