ঢাকা: প্রচলিত আছে, ‘যেমন কুকুর, তেমন মুগুর’! অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হয়ে সভ্য আচরণ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। তবে নারী কূটনীতিকের সঙ্গে ‘চরম অশোভনীয়’ আচরণের পাল্টা কড়া জবাব পাওয়ার পর ভারতের সামনে থেকে একরকম লেজ গুটিয়েই শেষ রক্ষা পেতে চাইছে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রটি!
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে, নারী কূটনীতিককে বিবস্ত্র করে দেহ তল্লাশির পর হাজতে পাঠানোর ঘটনায় বুধবার ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেননকে ফোন করে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়েকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠানোর জের ধরে পরাশক্তি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে চরম উত্তেজনা ছড়ানোর মধ্যে মেননকে ফোন করে এই দুঃখ প্রকাশ করেন কেরি।
কেরি ও মেননের ফোনালাপে কথা নিশ্চিত করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মারি হার্ফ বলেন, দেবযানীর সমবয়সী দুই মেয়ের বাবা হিসেবে কেরি ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেননকে ফোন করে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।
হার্ফ জানান, ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আঘাত লাগে এমন কোনো বিষয় যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করবে না বলে মেননকে জানিয়ে দিয়েছেন কেরি।
মেননের সঙ্গে কেরির এই ফোনালাপকে নিজেদের জন্য ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছে ভারত সরকার।
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও কেন কেরি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদকে ফোন করলেন না, অথবা সালমান খুরশিদকে ফোন করে যোগাযোগ ব্যর্থ হয়েছেন কিনা এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না কোনো দেশের সংবাদ মাধ্যমই।
নারী গৃহপারিচারিকাকে প্রতিশ্রুত বেতন না দেওয়া এবং ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের রাস্তায় প্রকাশ্যে দেবযানীকে হাতকড়া পরিয়ে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিবস্ত্র করে দেহ তল্লাশির পর তাকে মাদকসেবীদের সঙ্গে হাজতবাসে বাধ্য করা হয়।
ওই ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানায় নয়াদিল্লি এবং এই ঘটনাকে ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সহ ভারতের কর্তা ব্যক্তিরা।
তবে, মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর এমন ‘বর্বর ও ঘৃণ্য’ আচরণের পর সম্পূর্ণ নিরাপত্তা সুবিধা পেতে দেবযানীকে নিউইয়র্কের কনস্যুলেট থেকে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে পদায়ন করেছে ভারত সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবমাননাকর আচরণের জবাবে নয়াদিল্লিও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে।
গত মঙ্গলবারই ভারতজুড়ে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পরিচয়পত্র জমা দিতে বলে নয়াদিল্লি। কনস্যুলেট ও দূতাবাস কর্মকর্তাদের সবরকমের এয়ারপোর্ট পাস প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশি ব্যারিকেড সরিয়ে নেওয়ার জন্য নয়াদিল্লি পুলিশকে বলা হয়।
এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে কর্মরত ভারতীয় কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিবরণ এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের বাসভবনে গৃহস্থালির কাজ করা শ্রমিকদের বেতন-ভাতার বিবরণসহ দূতাবাস ও কনস্যুলেটের বিভিন্ন খুঁটিনাটি কার্যক্রমও জানতে চায় নয়াদিল্লি।
যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলের ভারতীয় শাখাগুলোর শিক্ষকদের ভিসার বিবরণ চাওয়ার পাশাপাশি তাদের বেতন-ভাতার বিবরণ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ব্যাপারেও তথ্য জানতে চাওয়া হয়।
এছাড়া, মার্কিন দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোর জন্য বিশেষ আমদানি অগ্রাধিকারও প্রত্যাহার করা হয়।
এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি ভারতের কূটনেতিক সূত্র জানায়, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যদি বলে দেবযানীর প্রাপ্য সীমিত নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে, তবে মার্কিন কর্মকর্তাদেরও তাদের প্রাপ্য সীমিত নিরাপত্তা ও সুবিধা দেওয়া হবে।
এর আগে, মঙ্গলবার সকালেই ‘জাতীয় সংহতির’ স্বার্থে ভারত সফররত মার্কিন কংগ্রেসের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানান ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিনধে। মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আগামী নির্বাচনের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদিও।
নারী কূটনীতিকের সঙ্গে এমন আচরণকে ‘ঘৃণ্য ও বর্বর’ উল্লেখ করে কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সোমবার নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেনন। বৈঠক বাতিল করেন লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারও।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরাগাড়েকে বিবস্ত্র করে দেহ তল্লাশির পর হাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জামিনের আগে দেবযানীকে হাজতে মাদকসেবী ও রাস্তার যৌনকর্মীদের সঙ্গে রাখা হয়।
পরে ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলারে জামিনে মুক্ত হন দেবযানী।
উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিকের সঙ্গে এমন আচরণ করায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বেজায় চটে ভারত।
এ ব্যাপারে দেবযানী কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি চরম অবমাননাকর মনে করছে নয়াদিল্লি।
গত, বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে নিজের মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে কূটনীতিক দেবযানীকে বিবস্ত্র করে তার দেহ তল্লাশি করা হয় এবং প্রকাশ্যেই তাকে হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নেওয়া হয়।
ওই ঘটনার একদিন পর পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলকে তলব করেন এবং এ ঘটনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য আচরণ’ আখ্যা দিয়ে এর জোরালো প্রতিবাদ জানান।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের পক্ষ থেকে করা প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নোয়েল ক্লে’র পক্ষ থেকে বলা হয়, দেবযানীকে আটকের সময় সর্বোচ্চ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।
এছাড়া, আরও কোনো তথ্য জানার থাকলে প্রশাসনিক বাহিনী মার্শালস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। তবে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি মার্শালস কর্তৃপক্ষ।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা ক্লে দাবি করেন, ভিয়েনা কনভেশনের আওতায় ভারতের ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসাবে দেবযানী সবরকমের নিরাপত্তা ও কূটনীতিক ছাড় পাওয়ার দাবিদার।
দেবযানীর সঙ্গে এহেন আচরণের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে বলে দাবি করে ভারত। ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো কূটনীতিক যদি ‘গুরুতর অপরাধ’ করে থাকেন, তবেই কেবল তাকে গ্রেফতার করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, দেহতল্লাশির নামে দেবযানীর নারীত্বের সম্ভ্রমের প্রতি হানিকর আচরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি এহেন ন্যক্কারজনক আচরণের পক্ষে ঢালাই সাফাইও গেয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩
সম্পাদনা: হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর