ঢাকা: পুলিশ বাহিনীর গায়ে যখন দুর্নীতিবাজের তকমা, তখন সাধারণ জনতার কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। মৃত্যুকে পরোয়া না করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়েছেন ।
বিচারের ধার না ধেরে ন্যায্য যা মনে করেছেন সেভাবেই সাজা দিয়েছেন সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের। কখনও ‘এনকাউন্টারে’ খতম করে দিয়েছেন, আবার কখনও জেলের খাঁচায় পুরেছেন।
সন্ত্রাসী আর জঙ্গিদের কাছে ‘কুখ্যাত’ হলেও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে ‘বিখ্যাত’ এসপি চৌধুরী আসলাম খান। সন্ত্রাসী হামলায় মারা গিয়েই প্রমাণ দিলেন ‘মরে যাব তবু সন্ত্রাসীদের কাছে মাথা নত করব না’ নীতিতে অটল তিনি।
সন্ত্রাসীরা কোন পথে হাঁটে, কখন বের হয় তা ছিল তার নখদর্পে। নিয়ম করে তিনি রাতে বের হতেন অভিযানে। এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে পিস্তলসহ সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত চৌধুরী আসলামকে বলিউডের ‘ভিলেন’ মনে হয়। আসলেই তিনি ভিলেনদের ভিলেন।
সাজোয়া যানে অভিযানে যাওয়ার সময় তার আশপাশে থাকতেন পুলিশের চৌকস কর্মকর্তারা। বলিউডের ভিলেনদের চারপাশে যেমন গ্যাংয়ের সদস্যরা থাকে তেমনি তার সঙ্গে সাদা পোশাকে গ্যাংস্টার হিসেবে থাকতেন ওইসব কর্মকর্তা।
ব্যতিক্রমী অভিযান আর দুঃসাহসিকতার কারণে মার্কিন থ্রিলার ফিল্ম ‘ডার্টি হ্যারি’র নায়কের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাকে। ডন সিজেল পরিচালিত ডার্টি হ্যারির নায়কের মতো তিনিও শহরে শান্তি ফিরিয়ে আনতে নিজেই অপরাধীদের শাস্তি দিতেন।
এ বিষয়ে রেহমান ডাকাতের ‘এনকাউন্টার’ এর কথা বলা যেতে পারে। অভিযানে আত্মরক্ষার্থে গুলি করলে রেহমান ডাকাত নিহত হয় বলে দাবি করেন চৌধুরী আসলাম। কিন্তু ২০১০ সালের ওই ঘটনা সম্পর্কে রেহমানের পরিবারের দাবি, গ্রেফতার করার পর রেহমানের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে ও পরে মেরে ফেলা হয়েছে।
পাকিস্তানিরা নিয়মিত বিরতিতে এরকম ‘এনকাউন্টার’-এর কথা শুনতে পেতেন। তবে চৌধুরী আসলামের ‘এনকাউন্টার-এ ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসীরাই প্রাণ হারাত।
নির্দোষ এক ব্যক্তিকে ‘এনকাউন্টার’-এ মেরে ফেলার অভিযোগে তাকে ২০০৬ সালে ১৮ মাস জেলেও খাটতে হয়েছে। তবে সুপ্রিম কোর্ট তাকে পরে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন।
‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ খেতাবও জুটেছিল তার। এ সম্পর্কে ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি বলেছেন, ‘আমি অনেককে জীবিত গ্রেফতার করেছি, তারা কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, তারপরও কেন লিয়ারির মানুষ আমায় ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ বলেন। ’
সন্ত্রাস দমনে অনন্য অবদান রাখার অনেক পুরস্কার ও নগদ অর্থও পেয়েছেন তিনি। পাকিস্তান পুলিশ মেডেল, কায়েদে আজম পুলিশ মেডেল অর্জন করেছেন। গত মার্চে প্রেসিডেন্ট তার হাতে তুলে দিয়েছেন তাগমা-ই-ইমতিয়াজ পুরস্কার। বিভিন্ন সময়ে পুরস্কার হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার পাউন্ড।
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও তালিবানের সন্দেহভাজন কয়েকজন সদস্যকে ‘এনকাউন্টারে’ মেরে ফেলেছিলেন চৌধুরী আসলাম।
৩০ বছরের পুলিশি জীবনের ইতি ঘটলো বৃহস্পতিবার বিকেলে। করাচির লিয়ারি এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় শক্তিশালী বোমা হামলায় নিহত হন তিনি। পাকিস্তানের নিষিদ্ধঘোষিত তেহরিক-ই-তালিবানের হামলায় ঝড়ে পড়লেন এ নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তা।
গত বছরও একই জায়গায় চৌধুরী আসলামকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছিল। এর আগে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তার বাড়ির ফটকে বোমাসহ ট্রাক ঢুকিয়ে দেন জঙ্গিরা। পুলিশ সদস্যসহ ৮ জন নিহত হলেও আসলামের পরিবার থাকে অক্ষত।
ওই হামলার পর তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘এখানেই হামলাকারীদের কবর দেবো। ’ আততায়ীদের বিরুদ্ধে নিজের ‘জিহাদ’ ঘোষণা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম না সন্ত্রাসীরা এতো কাপুরুষ হয়। কেন তারা সামনে এসে আমাকে হামলা করে না?’
পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীর জন্য চৌধুরী আসলামের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি- এমনটাই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তিনি বলেছেন, চৌধুরী আসলাম একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।
১৯৮৪ সালে সহকারি পুলিশ উপ-পরিদর্শক হিসেবে পাকিস্তান পুলিশে যোগ দেন তিনি। ২০০২ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পদায়ন পান। সিআইডি’তে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০০৪ সালে পুলিশ সুপার পদে উন্নীত হন তিনি। ২০১০ সালে তাকে সিআইডির সন্ত্রাসবিরোধী সেলের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৪
সম্পাদনা: শরিফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর