ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে ব্র্যাড অ্যাডামস-এর প্রতিবেদন

বিএসএফ নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা করছে

রানা রায়হান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১১
বিএসএফ নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা করছে

ঢাকা: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তার খবর এবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। ব্রিটেনভিত্তিক দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এ ব্যাপারে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।



মন্তব্য প্রতিবেদনটি লিখেছেন আন্তর্জাতিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস। ‘ইন্ডিয়াস শ্যুট-টু-কিল পলিসি অন দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ (India`s shoot-to-kill policy on the Bangladesh border) শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশিদের ওপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশিদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে ‘বৈধ’ বলে দাবি করার ভারতীয় হঠকারিতারও নিন্দা করা হয়েছে তীব্র ভাষায়।  

এতে ‘বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বৈধ’ বলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের প্রধান রমণ শ্রীবাস্তবকে উদ্ধৃত করা হয়। রমণ এও বলেছেন ‘এজন্য কারও অনুতপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ’

ব্র্যাড অ্যাডামস লিখেছেন-
ভারতের সীমান্তরক্ষীরা প্রকাশ্যেই বলছে, নিরস্ত্র বেসামরিক বাংলাদেশিরা ভারতে প্রবেশ করতে গেলেই তাদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। এতে সরকারের কী করণীয়?

শক্ত কাঁটাতারের বেড়া দিলেই কী ভালো প্রতিবেশি পাওয়া যায়? ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে তাকালে সেটা মনে হবে না। ভারত দুই হাজার কিলোমিটার বেড়া নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। একসময় দুই পাশের মানুষ বৃহৎ বঙ্গের অংশ ছিল। আর এখন ভারত অবৈধ অভিবাসন, চোরাচালান ও জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ‘দূরে থাকো’ সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে।

অভিবাসনের ব্যাপারে ক্রমেই বৈরি হয়ে ওঠা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটা ব্যতিক্রম কিছু না। তবে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর শ্যুট-টু-কিল (গুলি করে হত্যা) নীতি চালাচ্ছে। তাদের গুলিতে নিহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। গত ১০ বছরে বিএসএফের গুলিতে এক হাজার নিহত হয়েছে, এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। দক্ষিণ এশিয়ার ওই সীমান্ত অঞ্চলটি (ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত) ‘হত্যাযজ্ঞের ময়দানে’ পরিণত হয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞের অপরাধে এ পর্যন্ত কারোরই বিচার হয়নি। অথচ বহু ক্ষেত্রেই প্রমাণ আছে, নিরস্ত্র ও প্রতিরোধহীন এসব বেসামরিক সীমান্ত অঞ্চলবাসীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে।

দুঃখজনক হলো, নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকারীকে দেখা মাত্র গুলি করার বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সায় রয়েছে। মেক্সিকো সীমান্তে একটা হত্যার ঘটনা ঘটলেই তার ফলাও শিরোনাম হয়। অথচ বিএসএফের গুলিতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি মারা গেলেও সে খবর উপেক্ষিত থেকে যায়।

সীমান্তে সহিংসতা চলছে নিয়মিত ও স্বেচ্ছাচারী পন্থায়।

হিউমান রাইটস ওয়াচের কাছে জনৈক আলাউদ্দিন বিশ্বাস বিএসএফের গুলিতে তার ২৪ বছর বয়সী ভাগ্নের মৃত্যুর বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘তাকে যখন গুলি করা হয় তখন সে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। তারা তার কপালে গুলি করে। যদি সে দৌড়ে পালাত তাহলে পেছন থেকে গুলি করত। এভাবেই তারা ওকে মেরে ফেলল। ’

এ ঘটনায় বিএসএফ’র দাবি ছিলো, তারা কেবল আত্মরক্ষার জন্যই গুলি চালায়। অথচ ছেলেটির কাছ থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।

মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভোর তিনটায় আমরা সীমান্ত পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ’ গরু চোরাচালান করে বাংলাদেশে নিয়ে আসারজন্য ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন তিনি । নজরুল বলেন, ‘বিএসএফ আমাদের দেখে ফেলা মাত্র বিনা উস্কানিতে আমাদেও ওপর গুলি চালায়। ’ হাতে গুলি লাগায়  এযাত্রা নজরুল বেঁচে যান।

বিএসএফের নির্যাতনের  শিকার অনেক শিশুও রয়েছে। বিএসএফের হাতে নিজ ছেলেদের মার খাওয়া সম্পর্কে একজন বাবা বলেন, ‘বিএসএফের লোকজন ছেলেদের ঘিরে ফেলে এবং কোনো কারণ ছাড়াই রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে শুরু করে। চড়-লাথি চলতে থাকে। বিএসএফের নয়জন একযোগে আমার ছেলেদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে। ছেলেরা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তারা লাথি মারতে শুরু করে, এমনকি স্পর্শকাতর গোপনাঙ্গেও তারা মেরেছে। ’

ব্র্যাড অ্যাডামস আরো লিখেছেন, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আইন আরোপ করার অধিকার ভারতের আছে বটে। তবে আত্মরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছাড়া অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের (বিএসএফ) ব্যবহারের অনুমতি নেই। ভারতের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ব্যাপারটা খোলাখুলি ও বড় গলায় স্বীকারও করেছেন। এ ব্যাপাওে দু:খপ্রকাশের লেশমাত্র সৌজন্যবোধও তারা দেখাননি। বরং নিহত বাংলাদেশিদের ব্যাপারে তাদের কন্ঠে ঝরেছে বরং রাজ্যের অবজ্ঞা। বিএসএএফ প্রধান রমণ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘নিহত ব্যক্তিদের জন্য কারও দুঃখ করা উচিৎ না। ’ এর কারণ হিসেবে তিনি দাবি করেন, ‘ভারতের ভূখণ্ডে ওরা অবৈধ প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। এসব ঘটনা প্রায়শই রাতে ঘটে। ওরা নিরীহ নয়, ওদের গুলি করা বৈধ। ’

ভারতে একটি কার্যকর আদালত আছে। আপাতভাবে সেই আদালত মনে করেন, বিচারক, জুরি ও মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেওয়া ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতে পারে বিএসএফ। ভারতের এই আচরণের শিকার ১৩ বছর বয়সী আবদুর রাকিব, ছেলেটা কোনো আইন ভাঙেনি। কেবল সীমান্তবেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। দুঃখজনকে হলেও, বাংলাদেশের কর্মকর্তারাও বলেছেন, চোলাচালানি কাজে জড়িত থাকলে এরকম হত্যা গ্রহণযোগ্য।

ব্র্যাড অ্যাডামস আরো লিখেছেন, ভারতের অর্থনীতি বড়ো হয়েছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ভিড় জমাচ্ছে। বিশ্বের ক্রমউত্থানশীল দেশ হিসেবে ভারতের প্রভাব দিনদিন বাড়ছে। তবে ভারতকে বুঝতে হবে, এর আচরণ নজরদারির মধ্যে আনা দরকার। পৃথিবীর বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ নিয়মিতভাবে গরিব ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যাসহ এমন অন্যায় আচরণ করবে তা কাম্য নয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।